পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা, তদন্তের নির্দেশ
প্রেমের ফাঁদে ফেলে মার্কিন নাগরিক হত্যা
প্রথম নিউজ, ঢাকা: বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক সাফায়েত মাহাবুব ফারায়জী গত বছরের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে এসেছিলেন মায়ের জন্মদিনে সারপ্রাইজ দিতে। ডিসেম্বরে তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। প্রেমের ফাঁদে ফেলে তাকে হত্যা করা হয়েছে এমন অভিযোগ করে হত্যাকাণ্ডের দেড় মাস পর আদালতে মামলা করেছেন ফারায়জীর মা শামীমুন নাহার লিপি। তিনি অভিযোগ করেছেন হত্যাকাণ্ডের পর থানায় মামলা করতে গেলেও তাকে সেই সুযোগ দেয়া হয়নি। উল্টো তিনি হুমকির শিকার হয়েছেন। বাধ্য হয়ে আদালতে মামলা করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রাজধানীর বাড্ডা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার এবং ভাটারা থানার উপ- পরিদর্শকসহ মোট ৮ জনকে আসামি করে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বুধবার মামলাটি করেন শামীমুন নাহার লিপি। এজাহারে হত্যাকাণ্ডের সময় হিসাবে গত বছরের ২৫শে ডিসেম্বর রাত পৌনে ১২টা থেকে ২৭শে ডিসেম্বর দুপুর দেড়টার কোনো একটি সময় উল্লেখ করা হয়। পরদিন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেলের মর্গে সাফায়েতের ক্ষতবিক্ষত মরদেহ শনাক্ত করেন তার মা।
সাফায়েত আমেরিকায় থাকাকালীন মামলার প্রধান আসামি সুজানার সঙ্গে মুঠোফোনে পরিচয় হয়। পরবর্তীতে দেশে এলে সুজানা কৌশলে তাকে ফাঁদে ফেলে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে না পেরে হত্যা করেন। এতে পুলিশের একাধিক সদস্য সাফায়েতকে হত্যায় সহায়তা করেন বলেও অভিযোগ করা হয়। ভাটারার পশ্চিম নুরের চালার যে বাসায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে সেখানকার একটি সিসি টিভি ভিডিও ফুটেজও আছে। মামলার আসামিরা হলেন, সুজানা তাবাসসুম সালাম, বাড্ডা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. তয়াছের জাহান, মো. আফতাব, মো. শাখাওয়াত, মো. আসওয়াদ, বাড়ির মালিক মো. কামরুল হক ও কেয়ারটেকার মো. রিপন। এছাড়া ভাটারা থানার উপ- পরিদর্শক (এসআই) মো. মশিউরসহ অজ্ঞাত আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে। বাদীর অভিযোগ, এর আগে হত্যা মামলা করতে ভাটারা থানা ও ডিএমপিতে একাধিকবার গেলেও পুলিশ আমলে নেয়নি। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সহায়তায় গতকাল আদালতে হাজির হয়ে হত্যা মামলা করেন। মামলা নম্বর সিআর ৯৮/২০২২। মামলাটি আদালত গ্রহণ করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। আগামী ৯ই ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
নিহতের মা শামীমুন নাহার বলেন, আমার ছেলের হত্যাকাণ্ডের ৪৫ দিন অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত কোনো থানা মামলা নেয়নি। দূতাবাসের সহযোগিতায় অবশেষে আদালতে মামলা করার সুযোগ পাই। অথচ আমি নিজে একজন মানবাধিকার কর্মী। ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। কিন্তু কেউ আমার কথা শোনেননি। এজাহারে বলা হয়, মামলার আবেদনকারী শামীমুন নাহার লিপি একজন বাংলাদেশি ও আমেরিকান নাগরিক। তার বাবা ছিলেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব। বাবার চাকরির সুবাদে ১৯৭৭ সালে শামীমুন নাহার লিপি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। এবং যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ ও ডোমেস্টিক ভায়ালেন্স বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার সঙ্গে মানবাধিকার কর্মী হিসেবে কাজ করেন। তিনি ‘হোপস ডোর বাংলাদেশ’- মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে বাংলাদেশের অবহেলিত মানুষের পাশে সহায়তার হাত বাড়ান।
জন্মসূত্রে শামীমুন নাহার লিপির বড় ছেলে সাফায়েত মাহাবুব ফারায়জী একজন আমেরিকান নাগরিক। সাফায়েতের বাবার সঙ্গে ডিভোর্সের পর দুই ছেলেকে নিয়ে আমেরিকায় বসবাস করে আসছিলেন তিনি। সাফায়েত আমেরিকায় পড়ালেখা শেষে একটি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। মা লিপি বাংলাদেশে থাকায় তার জন্মদিন উদ্যাপনে গত বছরের ২৯শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে আসেন। সাফায়েত দেশে আসার পর তার মায়ের সঙ্গে মামলার ১ নম্বর আসামি সুজানা তাবাসসুম সালাম, ৩, ৪ ও ৫ নম্বর আসামিকে তার বন্ধু বলে পরিচয় করিয়ে দেন। পরবর্তীতে মূল আসামি সুজানা সাফায়েতের মায়ের রামপুরার তালতলার ৩০৫/এ, ব্লক-বি খিলগাঁওয়ের বাসায় আসা- যাওয়া শুরু করেন। পরবর্তীতে বাসার গৃহকর্মী এবং কেয়ারটেকারের মাধ্যমে জানতে পারেন সুজানাসহ অন্য আসামিরা লিপির বাসায় মাদক গ্রহণ করতেন। এবং সাফায়েতকে তাদের সঙ্গে মাদক গ্রহণে উৎসাহিত করেন। বিষয়টি জানতে পেরে সাফায়েতের মা সুজানাকে তাদের বাসায় আসতে এবং সাফায়েতের সঙ্গে দেখা ও যোগাযোগ করতে নিষেধ করেন। পরবর্তীতে সুজানা ক্ষীপ্ত হয়ে গত বছরের ২৩শে নভেম্বর মামলার ৩, ৪, ৫ নম্বর আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে সাফায়েতের মায়ের বাসায় এসে তাদেরকে মারধর করেন। রামপুরা থানায় ফোন দিলে পুলিশ এসে বিষয়টি মীমাংসা করেন। এরপর সাফায়েত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। গত ১০ই ডিসেম্বর সাফায়েত এবং তার মা গুলশানে গেলে ফেরার পথে সুজানা অন্য আসামিদের নিয়ে তাদের ওপর আতর্কিত হামলা চালায়।
এ বিষয়ে পরবর্তীতে গুলশান থানায় মামলা করতে গেলে থানা কর্তৃপক্ষ জানায় সুজানা এবং তার সিন্ডিকেট অনেক খারাপ। তাদের নামে সাধারণ ডায়েরি করলে অহেতুক বিপদে পড়তে হবে। পরদিন রাত সাড়ে ৯টার ভাটারা থানার উপ-পরিদর্শক (এস আই) মো. মশিউর তাদের বাসায় এসে সুজানার পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন, সুজানা ভালো মেয়ে। তার সঙ্গে যেন সাফায়েত যোগাযোগ নিয়মিত রাখেন। না হলে সাফায়েত দেশে থাকতে পারবেন না। সুজানা ওইদিনের ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়ে চলে যান। গত ২৫শে ডিসেম্বর বড়দিন উপলক্ষে সুজানা সাফায়েতকে তার বাসায় থেকে নিয়ে যান এবং রাত পৌনে ১২টায় বাসায় ফেরেন।
লিপি সাফায়েতকে বকাঝকা করলে এ সময় সুজানা সাফায়েতকে তার বাসায় পৌঁছে দিতে অনুরোধ করেন। রাতে ঢাকা-মেট্রো-গ-৩২-০১০৯ একটি প্রাইভেট গাড়িতে করে সাফায়েতকে তারা নিয়ে যান। এরপর আর সাফায়েত বাসায় ফেরেনি। পরবর্তীতে সাফায়েতের মুঠোফোন বন্ধ পেয়ে মা লিপি ভাটারা থানায় অভিযোগ করতে গেলে মামলার দ্বিতীয় আসামি বাড্ডা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মো. তয়াছের জাহান সুজানার বিষয়ে তারা কিছু জানেন না বলে তাকে ফেরত পাঠান। ২৭শে ডিসেম্বর দুপুর দেড়টায় ভাটারা থানা থেকে ফোনে বলা হয় আগের দিন সন্ধ্যা ৬টায় ভাটারার পশ্চিম নুরের চালার ১১৮৪ নম্বর নোভা মঞ্জিল থেকে সাফায়েতের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। পরে ভাটারা থানায় মামলা করতে গেলে সাফায়েতের মা’কে দুপুর ২টা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত বসিয়ে রেখে একাধিক সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে জানানো হয়, মরদেহ শহিদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে রয়েছে।এ সময় সাফায়েতের শরীরে একাধিক কোপানোর জখম দেখা গেছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, পরে লিপি জানতে পারেন, নোভা মঞ্জিলের ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে আসামিরা থাকতেন। ২৬শে ডিসেম্বর হত্যাকাণ্ড শেষে সেখান থেকে একাধিক সাক্ষীগণ তাদেরকে পালিয়ে যেতে দেখেন। গত ১লা জানুয়ারি সাফায়েতের মরদেহ বনানীর কবরস্থানে দাফন করা হয়। ২রা জানুয়ারি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থলে গেলে নোভা মঞ্জিলের মালিক এবং বাসার কেয়ারটেকার তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেন। এ সময় বাসায় সিসি টিভি ভিডিও ফুটেজ দেখতে চাইলে তারা খুনের বিষয়টি চেপে যাওয়ার হুমকি দেন। ৩রা জানুয়ারি ভাটারা থানায় মামলা করতে গেলে সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মো. তয়াছের জাহান ও উপ-পরিদর্শক মশিউর মামলা না করতে হুমকি প্রদান করেন। এবং তাকে আমেরিকায় ফিরে যেতে বলেন। সর্বশেষ গত ৯ই জানুয়ারি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বরাবর হত্যার বিচার চেয়ে আবেদন করলেও কোনো সাড়া মেলেনি। তয়াছের এবং মশিউর তাকে নিয়মিত হুমকি প্রদান করার পাশাপাশি আমেরিকায় চলে যেতে বলেন বলেও এজাহারে লিপি অভিযোগ করেন।
এজাহারে লিপি বলেন, মামলার আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে সাফায়েতকে হত্যা করেছে। এবং পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ডের আলামত নষ্ট করার পাশাপাশি তাকে অন্যায়ভাবে নিয়মিত হুমকি প্রদান করে আসছিলেন। নিরুপায় হয়ে আদালতে হাজির হয়ে একটি হত্যা মামলা করেন। লিপি বলেন, ছেলের হত্যাকারী মামলার এজাহারনামীয় আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। মামলার সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সারোয়ার হোসেন বলেন, মামলাটি আদালত গ্রহণ শেষে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলার বিষয়ে জানতে এজাহারভুক্ত আসামিদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে সুজানাসহ অন্যদের ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। বাড্ডা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মো. তয়াছের জাহান মানবজমিনকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ আনা হয়েছে সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। আনুষ্ঠানিকভাবে মামলার কাগজপত্র হাতে পেলে এ বিষয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানান এই কর্মকর্তা। এদিকে উপ- পরিদর্শক মশিউরকে ফোন দিলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাজিদুর রহমান বলেন, এ ঘটনার পরপরই সংশ্লিষ্ট থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। আমাদের থানার পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কি অভিযোগ মামলার কাগজপত্র পেলে এ বিষয়ে বলা যাবে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস এর উপ-কমিশনার (ডিসি) ফারুক হোসেন বলেন, অভিযোগের বিষয়ে তার জানা নেই। সূত্র: মানবজমিন।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: