Ad0111

পায়রা সেতুতে অস্বাভাবিক টোল, ভাড়া বাড়বে পরিবহনে

ফেরির ভাড়ার চেয়ে ক্ষেত্র বিশেষে আড়াই থেকে সাড়ে সাতগুণ বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে টোল

পায়রা সেতুতে অস্বাভাবিক টোল, ভাড়া বাড়বে পরিবহনে
পায়রা সেতুর টোল তালিকা

প্রথম নিউজ, বরিশাল: দক্ষিণাঞ্চলবাসীর বহুল কাঙ্ক্ষিত পায়রা সেতু উদ্বোধনের প্রথম দিনেই নির্ধারিত টোল নিয়ে অসন্তোষ জানিয়েছেন পরিবহন শ্রমিকরা। ফেরির ভাড়ার চেয়ে ক্ষেত্র বিশেষে আড়াই থেকে সাড়ে সাতগুণ বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে টোল। এতে বরিশাল-কুয়াকাটা রুটে সড়ক পথে ভাড়া বাড়বে বলে জানিয়েছেন পরিবহন মালিক ও যাত্রীরা।

ইতোমধ্যে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা টোল পুনর্বিবেচনার আবেদন স্থানীয় প্রশাসনকে জানিয়েছেন। তবে তাতে সাড়া মেলেনি। নির্ধারিত টোল ফি কমানোর দাবি নিয়ে আবারও তারা সেতু কর্তৃপক্ষের দারস্থ হবেন, প্রতিকার না পেলে সব বাহনের ভাড়া বাড়ানো হবে।

রোববার ও সোমবার (২৫ অক্টোবর) পায়রা সেতুর টোল প্লাজায় অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা গেছে পরিবহন চালক-শ্রমিকদের। এ নিয়ে টোল আদায়কারী প্রতিষ্ঠান এমএম বির্ল্ডাসের কর্মীদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা হতেও দেখা গেছে।

বরিশালগামী দিয়া পরিবহনের চালক ছত্তার হাওলাদার বলেন, বাসে সাড়ে তিনগুন বেশি টোল নির্ধারণ করেছে। ফেরিতে আমরা ভাড়া দিতাম ৯৫ টাকা। তাতে লেবুখালী পারাপার হতে ১৯০ টাকা খরচ হতো। এখন টোল নির্ধারণ করেছে ৩৪০ টাকা। সেতু পারাপার হতে একটি বাসের খরচ হচ্ছে ৬৮০ টাকা। এই টোল দেশের কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই।

এস আর পরিবহনের চালক নজরুল ইসলাম বলেন, বরিশালের অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলকারী বাসগুলোতে তেমন যাত্রী হয় না। তার ওপর এত বেশি টোল ধরা হয়েছে। এভাবে হলে আমাদের ভাড়া বাড়ানো ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।

ট্রাকচালক সুমন বলেন, ফেরিতে ভারী ট্রাক ভাড়া ছিল ১০০ টাকা। সেতুতে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে ৭০০ টাকা। আগের খরচের চেয়ে সাড়ে সাতগুণ টোল ধরা উচিত হয়নি। অবিবেচকভাবে টোল নির্ধারণ করায় আমাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ব্যয় বাড়ছে।

তিনি আরও বলেন, এত বেশি টোল নির্ধারণ না করে সামর্থ্যরে মধ্যে টোল নির্ধারণ করা উচিত। পর্যায়ক্রমে এই অঞ্চলের মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার হলে বাড়াবে।

থ্রি-হুইলার হারুন পঞ্চায়েত বলেন, আগে ১০ টাকা নিয়ে ফেরি পার হতাম। এখন সেখানে ৪০ টাকা টোল দিতে হচ্ছে। অথচ আমাদের গাড়িতে ছয়জন যাত্রী বসাতে পারি। তাতে ভাড়া পাই ৬০ টাকা। হারুন বলেন, ফেরি ভাড়ার চেয়ে দেড় বা দুই গুণ বেশি টোল আদায় করা যেতে পারে। এক লাফে তিন-চার গুণ বেশি আদায় আমাদের ওপর জুলুম।

জানা গেছে, ফেরিতে ভারী ট্রাকের ভাড়া ছিল ১০০ টাকা। পায়রা সেতুতে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৫০ টাকা। যা ফেরি ভাড়ার সাড়ে ৭ গুণ বেশি। বড় বাসের ফেরি ভাড়া ছিল ৯৫ টাকা, সেতুতে তা নির্ধারিত হয়েছে ৩৪০ টাকা। মাইক্রোবাসের ৪০ টাকার ফেরি ভাড়া হয়েছে ১৫০ টাকা। ফেরিতে ট্রেইলারের ভাড়া ছিল ৩৭৫ টাকা, সেতুতে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৪০ টাকা। মাঝারি ট্রাকে ফেরি ভাড়া ছিল ৯৫ টাকা, সেতুতে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৭৫ টাকা। ছোট ট্রাকের ফেরি ভাড়া ছিল ৯৫ টাকা, সেতুতে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ২৮০ টাকা। কৃষিকাজে ব্যবহৃত যানবাহনে ফেরি ভাড়া ছিল ৯০ টাকা, টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ২২৫ টাকা। 

কোস্টারে ফেরি ভাড়া ছিল ৫০ টাকা, সেতুতে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ১৯০ টাকা। চার চাকার মোটরযানে ফেরি ভাড়া ছিল ৪০ টাকা, সেতুতে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫০ টাকা। সেডান কারে ফেরি ভাড়া ছিল ২০ টাকা, সেতুতে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৫ টাকা। ৩/৪ চাকার যানে ফেরি ভাড়া ছিল ১০ টাকা, সেতুতে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০ টাকা। মোটরসাইকেলে ফেরি ভাড়া ছিল ৫ টাকা, সেতুতে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ টাকা। রিকশা, ভ্যান, সাইকেল ও ঠেলাগাড়িতে ফেরি ভাড়া ছিল ৫ টাকা, সেতুতে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ টাকা।

রূপাতলী বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাওছার হোসেন শিপন বলেন, পায়রা সেতুতে অতিরিক্ত টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। টোল পুনর্বিবেচনা করে নির্ধারণের জন্য বরিশাল বিভাগের সব জেলার মালিক-শ্রমিক সমিতি সেতু কর্তৃপক্ষকে আলাদা আলাদাভাবে চিঠি দিয়েছে। সেতু কর্তৃপক্ষ আমাদের জানিয়েছেন, টোল মন্ত্রণালয় থেকে নির্ধারণ করে দিয়েছে। আমাদের দাবির বিষয়টি তারা মন্ত্রণালয়ে জানাবেন। তবে টোল পুনর্বিবেচনার আবেদনের বিষয়ে পায়রা সেতুর দফতর থেকে এখনও কোনো আশ্বাস দেয়নি। এই পরিবহন নেতা বলেন, এখনই বাসভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

বরিশাল জেলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান সালাম বলেন, পায়রা সেতুর উদ্বোধনের মধ্য থেকে পরিবহন সংশ্লিষ্টদের অনেক উপকার হয়েছে। পায়রা বন্দরে পণ্য আনা-নেওয়া বাড়বে। কিন্তু পায়রা সেতুতে যে টাকা টোল নির্ধারণ করা হয়েছে তা আমাদের সাধ্যের বাইরে। এত বেশি টোল আমরা দিতে পারব না। এতে করে ব্যবসায়ীদের খরচ বেশি হবে। পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। 

সড়ক ও জনপথ পটুয়াখালী সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাসুদ খান বলেন, নির্ধারিত টোল ফি সর্ম্পকে সবারই আপত্তি উঠেছে। অনেকেই দাবি তুলেছেন টোল কমানোর। আমরাও বিবেচনা করছি। যদিও বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে। তবে আমরা সুপারিশ করতে পারব। কারণ এখানকার ৩৫ কিলোমিটার অতিক্রম করতে গিয়ে তিনটি সেতু পার হতে হচ্ছে। সবগুলো সেতুতেই টোল দিতে হচ্ছে পরিবহন সংশ্লিষ্টদের। ফলে কোনো টোলে অস্বাভাবিক ফি আদায় হলে সেই চাপ কিন্তু সঙ্গত কারণেই যাত্রী ভাড়ার ওপরে পড়বে। এ জন্য আমরা সুপারিশ করব পায়রা সেতুর টোল পুনর্বিবেচনা করার জন্য।  

প্রসঙ্গত, রোববার (২৪ অক্টোবর) গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে পায়রা সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশি-বিদেশি ১৩০০ এর বেশি শ্রমিক পাঁচ বছর কাজ করে নির্মাণ করেছেন সেতুটি।  সেতুতে ৩২টি স্প্যান, ৫৫টি টেস্ট পাইল, ১৬৭টি বক্স গার্ডার, ২৮৬টি পাইল, ৩১টি পাইলক্যাপ, ২২৪টি আই গার্ডার স্থাপন করা হয়েছে। মূলত ২০১২ সালের ৮ মে একনেকে অনুমোদন পায় পায়রা সেতু প্রকল্প।

বাস্তবায়নকাল ধরা হয় ২০১২ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এতে ব্যয় ধরা হয় ৪১৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে কুয়েত ফান্ড থেকে ৩৩৬ কোটি ২৬ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়। বাংলাদেশ সরকার যোগান দেয় ৭৭ কোটি ৩ লাখ টাকা। ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফোরলেনবিশিষ্ট পায়রা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বাস্তবায়নে বিলম্ব হওয়ায় ২০১৫ সালের ৩১ মে ব্যয় প্রাক্কলন বাড়িয়ে ৪১৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়।

২০১৭ সালের ২০ জুন সংশোধিত ব্যয় প্রাক্কলন করে হয় ১ হাজার ২৭৮ কোটি ৮২ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়। যাতে ব্যয় বেড়ে যায় ৮৬৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। দ্বিতীয় দফায় ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সংশোধন করে করা হয় ১৪৪৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা। সময় বাড়ানো হয় ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে শুরু হয় সেতুর ভৌত কাজ। আর রোববার হয় উদ্বোধন।

সেতুটির দৈর্ঘ্য ১৪৭০ মিটার বা ৪ হাজার ৮২০ ফুট এবং প্রস্থ ১৯.৭৬ মিটার। এক্সট্রা ডোজ ক্যাবল পদ্ধতিতে নির্মিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেতু পায়রা। তবে এতে প্রথমবারের মতো ব্রিজ হেলথ মনিটরিং সিস্টেম (সেতুর স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ) চালু করা হয়েছে যা বজ্রপাত, ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অতিরিক্ত মালামালবোঝাই যানবাহন উঠলে সেতুটি ভাইব্রেশন তৈরি করে। ক্ষতির শঙ্কা থাকলে তা সংকেত দেবে।

কর্ণফুলি সেতুর মতোই পায়রায় লং স্প্যান অর্থাৎ ২০০ মিটার স্প্যান ব্যবহৃত হয়েছে। যা পদ্মা সেতুর স্প্যানের চেয়েও বড়। নদীর মাঝখানে একটি মাত্র পিলার ব্যবহার করা হয়েছে। ১৭ ও ১৮ নম্বর পিলারের পাইল ১৩০ মিটার গভীর, যা দেশের সর্বোচ্চ গভীরতম পাইল। সেতুটি নদীর জলতল থেকে ১৮ দশমিক ৩০ মিটার উঁচু। উভয় পাড়ে সাত কিলোমিটার জুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে সংযোগ সড়ক। পিলারের পাশে স্থাপন করা হয় নিরাপত্তা পিলার। সাবস্টেশনের মাধ্যমে সেতুতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। থাকছে সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা।

কুয়েত ফান্ড ফর আরব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট, ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ বিনিয়োগে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘লনজিয়ান রোড অ্যান্ড ব্রিজ কনস্ট্রাকশন’ সেতুটি নির্মাণ করে।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow

This site uses cookies. By continuing to browse the site you are agreeing to our use of cookies & privacy Policy from www.prothom.news