পুরোনো মামলা নিষ্পত্তিতে মনিটরিং কমিটি, কাজে ‘গতি’

 সম্প্রতি দুই দশক বা ২০ বছরের বেশি সময় আগের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে উদ্যোগ নিয়েছে দেশের প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।

পুরোনো মামলা নিষ্পত্তিতে মনিটরিং কমিটি, কাজে ‘গতি’
ফাইল ফটো

প্রথম নিউজ, ঢাকা: কক্সবাজারের সদর উপজেলায় প্রায় ২২ বছর আগে একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কৃষ্ণা রানী পাল নামের এক আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। কিন্তু সেই মামলায় এখনো হাইকোর্টে আপিল আবেদন করা হয়নি। ওই মামলাটি এখন নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টে এসেছে। একজন আইনজীবী এ বিষয়ে আপিল আবেদন প্রস্তুত করতে যাচ্ছেন। ঝিনাইদহের জরিনা আক্তার নামের অন্য এক আসামি একটি মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকলেও তার পরিবারের সদস্যরা জানতেন না তিনি কোথায় আছেন। সম্প্রতি কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া এক আসামির মাধ্যমে তার ভাই জানতে পারেন বিষয়টি। এরপর তিনি জরিনার জন্য আপিল করেছেন। সেটি এখন শুনানির অপেক্ষায়।

এভাবে বিভিন্ন মামলায় আসামিদের আপিল আবেদন করার নিয়ম না জানা, গুরুত্বপূর্ণ বা যে কোনো মামলায় নিয়মিত সাক্ষী উপস্থিত না হওয়া, বিচারিক (নিম্ন) আদালতের মামলায় উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ দেওয়ার ফলে বিচারকাজ বন্ধ থাকা, মামলা শুনানির জন্য মুলতবি রাখাসহ নানা কারণে অনেক মামলা ঝুলে আছে। এসব ঝুলে থাকা মামলার বিচার দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ করার উদ্যোগ নিয়েছেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। তারই আলোকে হাইকোর্ট বিভাগের আটজন বিচারপতিকে দেশের আটটি বিভাগে নিষ্পত্তি না হওয়া মামলা মনিটরিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাদের সহযোগিতার জন্য আরও আটজন কর্মচারীকে সাচিবিক দায়িত্ব পালনের জন্য বলা হয়েছে।

 সম্প্রতি দুই দশক বা ২০ বছরের বেশি সময় আগের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে উদ্যোগ নিয়েছে দেশের প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। সেসব মামলা নিষ্পত্তিতে অগ্রগতিও হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার ও স্পেশাল অফিসার ব্যারিস্টার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান জানান, সম্প্রতি দুই দশক বা ২০ বছরের বেশি সময় আগের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিয়েছেন দেশের প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। সেসব মামলা নিষ্পত্তিতে অগ্রগতিও হচ্ছে।

জানা গেছে, প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর আদেশে গত ২২ জুন সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে সংশ্লিষ্ট জেলা আদালতগুলোতে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা পাঠানো হয়। চলতি বছরের ১ ডিসেম্বরের মধ্যে এ ধরনের পাঁচ হাজার ৮৬১টি মামলা অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিষ্পত্তি করে হাইকোর্টে প্রতিবেদন পাঠাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই দশকের বেশি সময় আগের মামলায় বিচার না হয়ে আটকে থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা। বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। প্রধান বিচারপতির নির্দেশনা বাস্তবায়ন হলে বিচার যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি বাড়ছে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি।

এদিকে দেশের অধস্তন প্রতিটি দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত এবং ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণের নির্দেশনাও দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। এখন সেই তালিকা চূড়ান্তের কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার মো. গোলাম রাব্বানী।  দুই দশকের বেশি সময় আগের মামলায় বিচার না হয়ে আটকে থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা। বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। প্রধান বিচারপতির নির্দেশনা বাস্তবায়ন হলে বিচার যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি বাড়ছে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি। তিনি বলেন, অধস্তন আদালতের পক্ষ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মামলার সংখ্যা আমাদের কাছে আছে। এবার চলতি বছরের একটি সর্বশেষ সময় ধরে প্রত্যেক জেলা আদালতের তালিকা প্রেরণ করার জন্যে আমরা চিঠি দিয়েছি। এর পরিপ্রেক্ষিতে কাজ চলছে। সব আদালতের তথ্য না আসায় বিচারাধীন মামলার পূর্ণাঙ্গ তালিকা এখনও প্রস্তুত করা সম্ভব হচ্ছে না।

তিনি জানান, প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব গ্রহণের পরই বিচারাধীন মামলার প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণের নির্দেশ দেন। মামলার নথি গণনাপূর্বক এ সংখ্যা নির্ধারণ করতে বলা হয়েছিল। এছাড়া পুলিশ বা অন্য কোনো তদন্তকারী সংস্থার কাছে তদন্তাধীন মামলার প্রকৃত সংখ্যা পৃথকভাবে নির্ধারণ করে পাঠানোরও নির্দেশ দেন প্রধান বিচারপতি। বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই তালিকা প্রস্তুত হলে বিচারাধীন ও তদন্তাধীন মামলার প্রকৃত সংখ্যা বেরিয়ে আসবে। কারণ তদন্তাধীন মামলার সংখ্যাটা পাওয়া গেলেই দেশের আদালতসমূহে কত মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় তার প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে।

সুপ্রিম কোর্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, দুই দশক ধরে ঝুলে থাকা মামলার মধ্যে ঢাকা জেলা আদালতে রয়েছে ৬২৩টি, গোপালগঞ্জে ১৬টি, রাজবাড়ীতে ১৪টি, নরসিংদীতে তিনটি, নারায়ণগঞ্জে ৫৫টি, মাদারীপুরে ২২টি, টাঙ্গাইলে ১২টি, গাজীপুরে ৩১টি, মানিকগঞ্জে ৬টি, ফরিদপুরে ১৯টি এবং কিশোরগঞ্জ জেলা আদালতে ৬৭টি।  দুই দশকের বেশি সময় ধরে ঝুলে থাকা দেশের অধস্তন আদালতের মামলা নিষ্পত্তি তদারকির জন্য মনিটরিং কমিটি গঠন করা একটি ভালো উদ্যোগ। আশা করি এতে বিচারপ্রার্থীদের দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান হবে। 

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেন, মনিটরিং কমিটি করার পর মামলা নিষ্পত্তি এবং কাজের গতি বেড়েছে। বিচারকরা পূর্ণ কর্মঘণ্টা ব্যবহার করছেন এখন। পুরোনো মামলা নিষ্পত্তির জন্য সব সময়ই নির্দেশ ছিল। আশা করি ডিসেম্বরের মধ্যে এসব মামলা নিষ্পত্তি হবে। েমনিটরিং কমিটি নির্দেশ দিয়েছে, ২০০০ সালের আগের কোনো মামলা বিচারাধীন থাকতে পারবে না। এসব নিয়ে প্রধান বিচারপতিও কমিটির সঙ্গে কয়েকবার বৈঠক করেছেন, নির্দেশনা দিচ্ছেন। আমরা নিয়মিত তাকে এসব বিষয় জানাচ্ছি।

চলতি বছরের শুরুতে দেশের ২৩তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। এরপরই মামলাজট নিরসনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায় তাকে। এর মধ্যে দেশের আট বিভাগের অধস্তন আদালতের মামলা নিষ্পত্তি মনিটরিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় হাইকোর্টের আট বিচারপতিকে। বিভিন্ন পর্যায়ের অধস্তন আদালতের বিচারকরা দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করতে গিয়ে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন, তা অবহিত করেন মনিটরিং কমিটির বিচারপতিদের। মনিটরিং কমিটির বিচারপতিরা তখন অধস্তন আদালতের বিচারকদের দ্রুত নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে নানা নির্দেশনা দেন।

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনায় বলা হয়, অধস্তন আদালতের কার্যক্রম তদারকিতে গঠিত মনিটরিং কমিটি বিচারাধীন মামলার তথ্য সংগ্রহ করেছে। এতে দেখা যায়, ২২ বছর ধরে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মিলে ৫ হাজারের বেশি মামলা বিচারাধীন। এতে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত থাকা মামলা ছাড়া ২০০০ সাল ও তার আগের মামলাগুলো সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন।

প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ কমানোর বিষয়ে উদ্যোগ নেন। গত ২৭ জানুয়ারি আট বিভাগের জন্য হাইকোর্ট বিভাগের আটজন বিচারপতির নেতৃত্বে আটটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়। মনিটরিং কমিটি গঠনের পর দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারপতিরা বিভিন্ন আদালত পরিদর্শন করেছেন। সংশ্লিষ্ট জেলার বিচারকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন, তাদের সমস্যার কথা শুনেছেন। গত ১৪ মার্চ জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে সাত দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে অধস্তন আদালতের বিচারকদের প্রতি। এতে অধস্তন আদালতের বিচার কার্যক্রমে গতি বেড়েছে বলে জানা গেছে।

এই চিঠির সঙ্গে সংযুক্ত তালিকায় ২০০০ সালের আগে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৫ হাজার ৮৬১টি। এর মধ্যে ঢাকা জেলায় পুরোনো মামলার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ জেলায় ২০০০ সালের আগে দায়ের হওয়া বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৬১৫টি, যা এখনো অনিষ্পন্ন অবস্থায় পড়ে আছে। এসব মামলা ১ ডিসেম্বরের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে বলা হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির  বলেন, দুই দশকের বেশি সময় ধরে ঝুলে থাকা দেশের অধস্তন আদালতের মামলা নিষ্পত্তি তদারকির জন্য মনিটরিং কমিটি গঠন করা একটি ভালো উদ্যোগ। আশা করি এতে বিচারপ্রার্থীদের দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান হবে। আর ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুন নুর দুলাল বলেন, অধস্তন আদালতের মামলা নিষ্পত্তি তদারকির জন্য মনিটরিং কমিটি গঠন করাটি প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর একটি ভালো উদ্যোগ। তবে মামলাজট বিবেচনায় আরও বিচারক নিয়োগ দেওয়া দরকার। কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ডিজিটাল প্রক্রিয়ার ব্যবহার বাড়ানো দরকার বলে আমি মনে করি। বিচার বিভাগের জন্য বাজেট আরও বাড়ানো দরকার। কারণ বিচারাঙ্গনের সবার প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। এছাড়া সুপ্রিম কোর্ট বারসহ সব বারের সঙ্গে সমন্বয় এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সঙ্গে সমন্বয় করে মামলা নিষ্পিত্তিতে আরও সফল হওয়া যাবে বলে আশা সম্পাদকের।

২০১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি দেশের সব অধস্তন আদালত/ট্রাইব্যুনালকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাঁচ বছরের অধিক পুরোনো মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়। চলতি বছরের মার্চে এক নির্দেশনায় ১০ বছরের অধিক পুরোনো মামলা, আপিল ও রিভিশনসমূহ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তির নির্দেশনা দেন সুপ্রিম কোর্ট। এরপর এসে ২২ জুন পুরোনো মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom