পাঠ্যপুস্তকে মশা নিয়ে অধ্যায় চায় ডিএনসিসি: মন্ত্রণালয়ে চিঠি
পাঠ্যপুস্তকে মশা নিয়ে জনসচেতনতামূলক অধ্যায় থাকলে একটি সচেতন জাতি তৈরি হবে: কবিরুল বাসার
প্রথম নিউজ, ঢাকা: মশা নিধন বা নিয়ন্ত্রণ সিটি করপোরেশনের অন্যতম প্রধান কাজ। কিন্তু এ কাজটি ঠিকমতো করতে পারছে না ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। গত বছর রেকর্ড সংখ্যক মৃত্যু হয়েছে। আবার কিউলেক্স মশার উৎপাতেও মানুষ অতিষ্ঠ। মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা স্বীকার করছে সিটি করপোরেশন। খুঁজছে কার্যকর পদ্ধতি। এরই অংশ হিসেবে জনসচেতনতাকে গুরুত্ব দিতে পাঠ্যপুস্তকে মশা নিয়ে অধ্যায় চায় সিটি করপোরেশন। এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে চিঠিও দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
হালকা বর্ষা হতে না হতেই ঢাকায় বেড়েছে এডিস মশার উপদ্রব। প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। ২০ মে আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৫০। এমন পরিস্থিতিতে অনেকটা নড়েচড়ে হয়ে বসেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। সংস্থাটি জানিয়েছে, এডিস ও কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে বছরব্যাপী পরিকল্পনা নিয়েছে ডিএনসিসি। বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে জনসচেতনতায়। এরই অংশ হিসেবে পাঠ্যপুস্তকে এডিস ও কিউলেক্স মশা নিয়ে জনসচেতনতামূলক অধ্যায় যুক্ত করতে চায় ডিএনসিসি। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এমন একটি প্রস্তাব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় ইতিবাচক মতামত দিয়ে তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়েছে।
ডিএনসিসির এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, পাঠ্যপুস্তকে মশার ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে প্রতি শ্রেণিতে একটি করে অধ্যায় থাকা জরুরি। কারণ, জনগণের সচেতনতা ছাড়া মশা নিধন বা নিয়ন্ত্রণে সফল হওয়া কঠিন। এখন যদি স্কুল পর্যায়ে প্রতি শ্রেণিতে ডেঙ্গুজ্বর, চিকুনগুনিয়া, কালাজ্বরসহ অন্য ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে আলাদা অধ্যায় থাকে এবং তা ক্লাসে পড়ালে মশা নিয়ে একটা সচেতন জাতি তৈরি হবে।
তিনি বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশনের মশা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রোগ্রামে পাঠ্যপুস্তকে মশা নিয়ে আলাদা অধ্যায় যুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। আধুনিক বিশ্বের অনেক দেশেই পাঠ্যবইতে মশা নিয়ে সচেতনতার বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। এখন কিছুটা দেরি হলেও ডিএনসিসি এ উদ্যোগ নিয়েছে। আশাকরি পাঠ্যপুস্তকে মশার ক্ষতিকর দিকগুলো অন্তর্ভুক্ত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্মতি দেবে।
গত জানুয়ারিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আয়োজনে দেশটির ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের কমার্শিয়াল ল’ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (সিএলডিপি) আমন্ত্রণ ও অর্থায়নে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের একটি প্রতিনিধিদল ফ্লোরিডা সফর করে। মেয়র আতিকুল ইসলাম এ দলের নেতৃত্ব দেন। তারা সেখানে মশা নিধন কার্যক্রম নিয়ে কয়েকটি কর্মশালায় অংশ নেন। সরেজমিনে মশা নিধন কার্যক্রম দেখেন।
পরে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালীন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মেয়র আতিকুল ইসলাম জানান, মশা নিধনে ডিএনসিসি এতদিন ভুল পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। ভুল পদ্ধতির কারণে মশার লার্ভা ধ্বংস হয়নি বরং অর্থের অপচয় হয়েছে। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে মশার প্রজাতি চিহ্নিত করতে একটি ল্যাব স্থাপন করবেন। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে দেশে ফিরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি পাঠ্যপুস্তকে মশা নিয়ে অধ্যায় যোগ করার দাবি জানান।
ডিএনসিসির সচিব দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ডিএনসিসি মেয়রের নির্দেশে গত ২১ মার্চ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়। এ চিঠিতে পাঠ্যপুস্তকে মশা নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতামূলক অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়। তখন এ প্রস্তাবে সম্মতি দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। পরে তারা সুপারিশ করে এই চিঠি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।
এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ প্রস্তাব অনুমোদন করবে কি না বা করলে কী কী বিষয় থাকবে তা পর্যালোচনার জন্য শিগগির সভা আহ্বান করা হবে বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র।
ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা জাগো নিউজকে বলেন, মশা নিধন সিটি করপোরেশনের অন্যতম প্রধান কাজ। তাই মশা নিধনে আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে করপোরেশনের একার পক্ষে এটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এজন্য সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। একটা সচেতন জাতি তৈরি করতেই পাঠ্যপুস্তকে মশা নিয়ে জনসচেতনতামূলক অধ্যায় যুক্ত করতে উদ্যোগ নিয়েছে ডিএনসিসি।
তিনি বলেন, জনগণের পাশাপাশি সরকারের সেবা সংস্থাগুলোকে মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। যদিও আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় সিভিল অ্যাভিয়েশন, রাজউক, রেলওয়ে, পানি উন্নয়ন বোর্ড নিজ নিজ জলাশয়, ডোবা নিজেরা পরিষ্কার করবে বলে জানিয়েছে।
ডিএনসিসি ও ডিএসসিসির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মশা নিধনে সারা বছরই রুটিন অনুযায়ী কাজ করে ডিএনসিসি। তবে কিউলেক্স মশার চেয়ে এডিস মশা নিয়ে ডিএনসিসিকে বেশি বেগ পেতে হচ্ছে। এখন এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন কর্মসূচি চলছে। গত বছর বর্ষা মৌসুমে যখন নগরে এডিস মশার উপদ্রব বাড়ে, তখন শহরে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করে ডিএনসিসি। এ অভিযানের অংশ হিসেবে ডিএনসিসি ৫৪টি ওয়ার্ডে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। ছাদ বাগান পরিদর্শনে ড্রোন প্রযুক্তির ব্যবহার করে প্রায় ২৮ হাজার বাড়ির ছাদ পরীক্ষা করে ডিএনসিসি। এর মধ্যে দুই হাজার ২০০ বাড়িতে ছাদ বাগান চিহ্নিত করে। ২০০ বাড়িতে মশার প্রজনন ক্ষেত্র থাকার মতো পানির উপস্থিতি শনাক্ত করে তা ধ্বংস করা হয়।
ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান বলেন, সাধারণত এডিস মশা বাসাবাড়ির আঙিনায় পরিত্যক্ত পাত্রে জন্মায়। এর মধ্যে বাসার ছাদে এডিস মশার লার্ভা বেশি পাওয়া গেছে। তাই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতার বিকল্প নেই। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যদি মশার ক্ষতিকর দিক এবং তা নিয়ন্ত্রণের উপায় সম্পর্কে জানতে পারে তাহলে নগরে মশা নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে।
ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন পদক্ষেপের পাশাপাশি মশক নিধনে সর্বস্তরের মানুষের সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। তাই পাঠ্যপুস্তকে মশা নিয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে একটি অধ্যায় যোগ করার অনুরোধ জানিয়েছি। শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি মশার ক্ষতিকর দিকগুলো জানতে পারে, তাহলে অন্তত তাদের বাড়ির ছাদ, আঙিনা পরিষ্কারে গুরুত্ব দেবে। এতে বাড়িতে মশা জন্মাতে পারবে না। তিনি বলেন, কয়েক মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি শহরে সফর করেছি। সেখানে দেখেছি ‘মসকিউটোস বাইটস আর ব্যাড’—শিরোনামে একটি পাঠ্যবই রয়েছে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বইটি পড়ানো হয়। শিক্ষার্থীরা কার্টুন আকারে রং করে বইয়ের বিষয়বস্তু অধ্যয়ন ও অনুশীলন করে। আমাদের স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্যও পাঠ্যপুস্তক ও কার্টুন আকারে এ বিষয়ে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। মশক নিধনে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে চাই।
নগরীতে এডিস মশার কামড়ে প্রতিদিনই ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৬ মে পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক হাজার ২৯২ জন। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন ৭৬২ জন ও ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ছিলেন ৫৩০ জন। ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১২ জন।
এর আগে বিদায়ী বছর (২০২২ সালে) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২৮১ জন। বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ডেঙ্গুতে ২৭ জনের মৃত্যু হয়। একই সঙ্গে এই বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। এছাড়া ২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১-এ সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। একই বছর দেশব্যাপী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়।