প্রথম নিউজ, ডেস্ক : আব্বু দেখো-দেখো,পাকিস্তানেও আওয়ামী লীগ আছে! করাচী জিন্নাহ বিমানবন্দর থেকে ইসলামাবাদগামী পিআইএ’র বিমানে চড়ে বসেছি।২০০৮ সালের জুলাই মাস। সাথে স্ত্রী ও দুই সন্তান।আমার স্ত্রীর সখ পাকিস্তান দেখবে,সেখানকার থ্রি-পিস,শাড়ি কিনবে! পুরোদস্তুর আওয়ামী লীগ পন্থী স্ত্রী পাকিস্তান কেন দেখতে চায় তার পুরোটা আর নাই বা বললাম!ওর ছোট মামা একজন বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা, বড় ভাই ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন।তারপরও পাকিস্তান দেখার আগ্রহ জন্মেছে আমার কাছ থেকে ইতিহাস, আমার সেখানে ভ্রমনের নানা কাহিনী শুনে। সেসময় ছেলে মেয়ের স্কুলে সামার ভ্যাকেশন চলছে। তাই অসুবিধে নেই। আমাদের পরিকল্পনা ছিল মালয়েশিয়ায় যাওয়ার। আপাতত পাকিস্তান যাবো বলে ঠিক করলাম। তখন সেখানে নিরাপত্তা অবস্থা বেশ নাজুক। আফগানিস্তানের চলমান সন্ত্রাস বিরোধি যুদ্ধের জন্য প্রায়ই এখানে ওখানে আত্মঘাতি বোমা ফোটে। কিন্তু আমরা পাকিস্তান সফরের প্রস্তুতি নিলাম। বাংলাদেশের খুব কম মানুষ পাকিস্তান সফরে যায়। পরিবার নিয়ে তো আরো কম।কানাডা প্রবাসী আমার শ্বাশুড়ি আমাদের পাকিস্তান যাত্রার কথা জেনে যারপরনাই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। আমি তাঁকে আশ্বস্ত করলাম নানা অজুহাত দেখিয়ে। কথা দিলাম ইসলামাবাদ পৌছেই তাঁকে তার মেয়ে ফোন করবে। ঢাকায় পাক দূতাবাসের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার সাজ্জাদ রসুলের সাথে দেখা করলাম স্ত্রী ও দুই সন্তানের পাসপোর্ট নিয়ে। পত্রিকায় প্রতিরক্ষা বিট আমাকে দেখতে হতো বলে ঢাকায় অবস্থিত প্রায় সব দূতাবাসের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা বা এ্যাটাশের সাথে আমার একধরনের সখ্যতা ছিল যা এখনও আছে। সেই সূত্রেই তাঁর সহায়তা চাওয়া।
আমার মাল্টিপল ভিসা আগেই ছিল। মাত্র ক’মাস আগে ইসলামাবাদে একটি সেমিনারে যোগ দিয়ে এসেছি। ব্রিগেডিয়ার সাজ্জাদ রসুল কারগিল যুদ্ধ ভেটেরান। তিনি ভিসা কাউন্সিলরকে ডেকে তখনি ভিজিট ভিসা লাগিয়ে দিতে বললেন। কফি ও স্ন্যাকস খেতে খেতে ভিসাসহ পাসপোর্ট পেয়ে গেলাম। এদিকে,পিআইএ’তে তখন টিকিটের অসম্ভব চাহিদা। দিনে দুটি ফ্লাইট। তারপরও টিকিট নেই। মধ্যপ্রাচ্যগামী বহু শ্রমিক পিআইএ’তে যাতায়াত করে বলে এই অবস্থা। ট্রাভেল এজেন্ট চেষ্টা করেও টিকিট জোগাড় করতে পারছিল না। আবার ব্রিগেডিয়ার সাজ্জাদের দ্বারস্থ হলাম। তিনি পিআইএ’র কান্ট্রি ম্যানেজারকে ফোন করে ডিসকাউন্টে টিকিটের ব্যবস্থা করে দিলেন। রাতের ফ্লাইটে রওয়ানা দিলাম। ভোরে করাচীতে পৌছার পর কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার সময় জানতে পারলাম আমাদের বিজনেস ক্লাসে আপগ্রেড করা হয়েছে।সবাই খুশি! তবে ঢাকা বিমানবন্দরে কি দিয়ে যেন আমার স্ত্রী পা কেটে ফেলেছেন। তা এতোক্ষণ আমাকে বলেনি। এনিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। ইসলামাবাদ পৌছেই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে টিটেনাসের ইন্জেকশন দিতে। কঠোর সিকিউরিটি চেকিং শেষ করে প্লেনে বোর্ডিং করে বসে আছি। বিজনেস ক্লাস বলে আগে উঠতে পারলাম ও বিমানের সামনের দিকে আসন পেলাম। আমার ছেলে শাবাব আইল সিটে,আমি উইন্ডো। ওপাশে আমার স্ত্রী ও মেয়ে।
হঠাৎ দেখি বিখ্যাত নায়ক নাদিম এগিয়ে আসছেন। নাদিম শুধু পাকিস্তানে নয়, বাংলাদেশেও সুপরিচিত। গত শতকের সত্তর দশকে শাবানার সাথে জুটি বেঁধে চকোরি ছবিতে অভিনয় করেছেন।বাংলাদেশ হওয়ার পরও তিনি কয়েকটি যৌথ প্রযোজনার ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন। বিয়ে করেছেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশামের কন্যাকে। সে হিসাবে তিনি বাংলাদেশের জামাই! সবাই আগ্রহ নিয়ে নাদিমকে দেখছেন। তার পরনে সালওয়ার কামিজ-কাবুলি ড্রেস।এর উপর ট্রাডিশনাল কালো আচকান।বঙ্গবন্ধুর সেই বিখ্যাত মুজিব কোটের মতো অনেকটা। তিনি এগিয়ে আসছেন...আমাদের সিট কেবল পার হয়েছেন। অমনি আমার ছেলে বলে উঠলো-আব্বু দেখো-দেখো, পাকিস্তানেও আওয়ামী লীগ আছে! নায়ক নাদিম থেমে দাড়ালেন! এক পা পিছিয়ে এসে শাবাবকে বললেন- বেটা, তুমি বাংলাদেশ থেকে এসেছো? আমি কি বলবো? দাড়িয়ে সালাম দিয়ে মাফ চেয়ে নিয়ে বললাম- আমার ছেলে ঠিক বুঝতে পারেনি!ওর বয়স মাত্র এগরো...
নায়ক নাদিম হেসে বললেন- আরে ভাই এটা নিয়ে আপনি ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? তারপর আমার ছেলের দিকে ফিরে,ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন- মাই সান, দিস ইস কমন ড্রেস ইন পাকিস্তান। তোমাদের বঙ্গবন্ধু যেটা পরতেন তা অনেকটা একইরকম। কিন্তু কিছু পার্থক্য আছে... তারপর তিনি হেটে সামনে এগিয়ে গেলেন। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
[প্রথম ছবি: ইসলামাবাদের শাকর পারিয়ায়। আমার দুই সন্তান। পিছনে যে চিকন গাছটি দেখা যাচ্ছে সেটা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার হাতে লাগানো। দ্বিতীয় ছবি: শাকর পারিয়ায় পাকিস্তানের জাতীয় সৌধে।তৃতীয় ছবি: বিখ্যাত পর্য়টন কেন্দ্র মারীতে। এটা পাহাড়ি এলাকা। অপূর্ব সুন্দর। মারী দিয়েই আজাদ কাশ্মিরে যেতে হয়]