‘নয়ন এমপির মাইরের কোনো আওয়াজ হয় না, ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়’
প্রথম নিউজ, লক্ষ্মীপুর: রায়পুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনি সভায় ও উঠানবৈঠকে উসকানিমূলক ও অশালীন বাক্য ব্যবহার করে পালটাপালটি বক্তব্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। এর মধ্যে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের এমপি নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়নের ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়েও বক্তব্য দিচ্ছেন দলের পদধারী নেতারা। এর মধ্যে ‘নয়ন ভাইয়ের মাইরের কোনো আওয়াজ হয় না, ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়, নয়ন এমপি ইশারা দিলেই তো ধুমা হয়ে যায়’- পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী জামশেদ কবীর বাকী বিল্লাহর এমন বক্তব্য নিয়ে ব্যাপক উত্তেজনা-আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। সিনিয়র নেতারা একে-অপরের বিরুদ্ধে নির্বাচনি সভায় প্রকাশ্যে পালটাপালটি বক্তব্য দিয়ে বিষোদগার করছেন। এতে তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে-গোপনে বিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন।
শনিবার বিকালে রায়পুরে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনসহ জনসাধারণ ও ভোটারদের উদ্দেশ্যে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে মর্মে নিশ্চয়তা এবং সব ভোটারদের তাদের নিজ নিজ ভোটাধিকার প্রয়োগের আহ্বান জানান জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ তারেক বিন রশীদ (পিপিএম)।
রোববার বিকালে শেষবারের মতো আনারস প্রতীকের প্রার্থী মামুনুর রশীদকে নিয়ে পৌর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বাসটার্মিনাল এলাকায় সভা এবং পুরো শহরে কেন্দ্রীয় আওয়ামী-যুবলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বিটিএমের সভাপতি মোহাম্মদ আলি খোকনের নেতৃত্বে বিশাল এক শোডাউন করা হয়েছে।
অপরদিকে একই দিন ও সময়ে উত্তর চরবংশী ইউপির খাসেরহাট বাজারে মোটরসাইকেল প্রতীকের প্রার্থীকে নিয়ে বিশাল সমাবেশ করে উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি হাজি ইসমাইল খোকনসহ কয়েকজন নেতা।
রোববার রাত ১০টার দিকে মধ্যে প্রার্থী মামুনুর রশীদের কর্মী আওয়ামী লীগ নেতা জহির পাটোয়ারী, উত্তর চরআবাবিল ইউনিয়নের মো. আলিম হোসেন মেম্বার ও উত্তর চরবংশী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান খালেদ দেওয়ানের ছেলে মো. নিহালকে আটক করে জেলা গোয়েন্দা সংস্থা (ডিবি)। কী জন্য তারা আটক তা পরে জানানো হবে বলে জানান ডিবির ওসি।
রোববার দুপুর ১২টায় চেয়ারম্যান প্রার্থী মামুনুর রশীদকে (আনারস) জেতাতে টিআর-কাবিখা প্রকল্পের লোভ দেখাচ্ছে লক্ষ্মীপুর-২ (রায়পুর ও সদরের একাংশ) আসনের সংসদ সদস্য নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন। সংবাদ সম্মেলন করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আলতাফ হোসেন হাওলাদার (মোটরসাইকেল প্রতীক)।
মঙ্গলবার রায়পুর পৌরসভার নয়টি ওয়ার্ডসহ ১০টি ইউনিয়নের ৭৯টি কেন্দ্রে ব্যালটের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ করা হবে। এ লক্ষ্যে নির্বাচনে ২২ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও তিন প্লাটুন (৮০ জন) বিজিবি সদস্য, পুলিশসহ বিপুলসংখ্যক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রস্তুতি রাখা হয়েছে বলে কমিশন জানায়।
এতে চেয়ারম্যান পদে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মামুনুর রশীদ (আনারস) ও উত্তর চরবংশী ইউনিয়ন কমিটির সাবেক সভাপতি আলতাফ হোসেন হাওলাদার (মোটরসাইকেল) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মামুনুর রশীদের সঙ্গে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের এমপি নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ আলী খোকনসহ আওয়ামী লীগসহ সহযোগী সংগঠনের পদবিধারী অধিকাংশ নেতা রয়েছেন। অধ্যক্ষ মামুনুর রশীদ নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়নের আপন ভগ্নিপতি এবং নয়ন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। আলতাফ হোসেন হাওলাদারের সঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি ও সাবেক মেয়র ইসমাইল খোকনসহ দলের একটি অংশ রয়েছে।
এদিকে আলতাফ হাওলাদারের পক্ষে আওয়ামী লীগের যেসব নেতাকর্মী গণসংযোগ ও প্রচার কাজে যাচ্ছেন ফেসবুকের ছবি দেখেই তাদের ম্যানেজ করা হচ্ছে। গত ১৫ দিনে চরপাতা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি খোরশেদ আলম, বামনীর আওয়ামী লীগ নেতা জাকির হোসেন পাটওয়ারী, কাউন্সিলর মো. ইউছুফসহ অন্তত ৩০-৪০ জন নেতাকে ‘ম্যানেজ’ করেছেন মামুনুর রশীদ ও তার অনুসারীরা।
তারা সবাই আলতাফ হাওলাদারের পক্ষে ছিলেন, ফেসবুকেও প্রচারণার ছবি আপলোড করেছিলেন। ছবি দেখেই তাদের ডেকে নিয়ে পদ-পদবি ও সুবিধা দেওয়ার কথা বলে ‘মন গলানো’ হয়েছে। পরে ওই নেতাদের মলিন মুখে ছবি ফেসবুকে মামুনুর রশীদ অনুসারীরা আপলোড করে ম্যানেজ ‘আলহামদুলিল্লাহ’ লিখছেন।
নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন প্রথম ২০১৫ সালের ৩ মার্চ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর তিনি রায়পুরে দলের গ্রুপিং নিরসনে নজর দেন। ২০২১ সালের ২২ নভেম্বর নুর উদ্দিন চৌধুরী উপনির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন। তিনি কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ আলী খোকনসহ সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বিভক্ত নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করেছেন।
উপজেলার পশ্চিমাঞ্চলের চরাঞ্চল খ্যাত চারটি ইউনিয়নে মোহাম্মদ আলী খোকন ও আলতাফ হাওলাদারের ভোট ব্যাংক রয়েছে। সর্বস্তরের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নুর উদ্দিন চৌধুরী ও মোহাম্মদ আলী খোকনের অনুগত। এরপরও সিনিয়র নেতাদের নিয়েই নয়ন এমপি দলকে সংগঠিত করেছেন।
উপজেলা নির্বাচনে মামুনুর রশীদ ও আলতাফ হাওলাদার চেয়ারম্যান প্রার্থী হন। নানা নাটকীয়তার পর নয়ন এমপির ভগ্নিপতি মামুনুর রশীদের পক্ষে কাজ করেন মোহাম্মদ আলী খোকন। এরপর আলতাফ হাওলাদার আওয়ামী লীগের একটি অংশকে সঙ্গে নিয়ে পুরোদমে মাঠে নেমেছেন। তার সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা ইসমাইল খোকন রয়েছেন।
আলতাফ হাওলাদারের পক্ষে যে নেতাকর্মীরা কাজ করছেন তাদের ম্যানেজ করা হচ্ছে। গত ১৫ দিনে চরপাতা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি খোরশেদ আলম, বামনীর আওয়ামী লীগ নেতা জাকির হোসেন পাটওয়ারী, কাউন্সিলর মো. ইউছুফসহ অন্তত ৩০-৪০ জন নেতাকে ‘ম্যানেজ’ করেছেন মামুনুর রশীদ ও তার অনুসারীরা।
সম্প্রতি আলতাফের অনুসারী ইউপি চেয়ারম্যান আবু সালেহ মিন্ট ফরায়েজী এক সভায় নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন এমপি ও মোহাম্মদ আলী খোকনের বিষয়ে চরম আপত্তিকর বক্তব্য দেয়। এর প্রতিবাদে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিলও করা হয়। ১০ নম্বর রায়পুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ নেতা জামশেদ কবির বাকী বিল্লাহ ইসমাইল খোকেনের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন। এর পালটা জবাবে ইসমাইল খোকন বক্তব্যে বাকী বিল্লাহকে চোর আখ্যায়িত করে আপত্তিকর বিভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন।
ওপরের বক্তব্যের বিষয়ে বাকি বিল্লাহ বলেন, ‘নির্বাচনি মাঠে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কর্মীরা অনেক কথাই বলে থাকেন। তবে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হোক আমরা সবাই তা চাই।’ আওয়ামী লীগ কর্মী আহসান মাল বলেন, নুর উদ্দিন চৌধুরী আর মোহাম্মদ আলী খোকন আমাদের রাজনৈতিক অভিভাবক। তাদের সবাই মানেন। একজন প্রার্থীর পক্ষ নিয়ে তারা নিজেরাই এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন।
চেয়ারম্যান প্রার্থী আলতাফ হোসেন হাওলাদার বলেন, এমপি প্রভাব বিস্তার করছেন। নেতাকর্মীরা আমার পক্ষে দেখলেই তাদের ডেকে নিয়ে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। দক্ষিণ চরবংশীসহ বিভিন্ন এলাকায় নেতাকর্মীদের মারধর করা হচ্ছে। এসব বিষয়ে আমি প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেছি।
রায়পুর পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন রুবেল ভাট বলেন, রায়পুরে দুই মাস আগেও আওয়ামী লীগ এক এবং ঐক্যবদ্ধ ছিল। উপজেলা নির্বাচন নিয়ে এখন কিছুটা বিভক্তি রয়েছে। কিছু নেতাকর্মীর মধ্যে মান-অভিমান রয়েছে। আলতাফ হাওলাদারের কোনো নেতাকর্মীকে আমরা মামুনুর রশীদের ভোট করার জন্য বাধ্য করছি না।
রায়পুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্রিয়াংকা দত্ত বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন করার লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। নির্বাচনে ২২ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ বিপুলসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকবেন। প্রার্থীদের অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন বলেন, নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ ভিত্তিহীন। প্রার্থীরা নিজেদের আঙ্গিকে প্রচার-প্রচারণা করছেন। যাদের জনপ্রিয়তা নেই, তারাই শুধু অভিযোগ নিয়ে হাঁটেন। তা ছাড়া আলতাফ হোসেন হাওলাদার ও মিন্টু ফরাজি দলের কেউ নন। তাদের নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি না।