নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ নেই নওগাঁর ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভোটারদের
প্রথম নিউজ, নওগাঁ : আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই নওগাঁর ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীর। তারা বলছেন, এই জনগোষ্ঠীর সদস্যরা প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার। নির্বাচন এলেই শুধু তাদের সংস্কৃতি ঐতিহ্য রক্ষা করা এবং জীবনমান উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি মেলে। নির্বাচনের পর তারা আর কাউকে পাশে পান না। তাই ভোটাধিকার প্রয়োগের আগ্রহ তারা হারিয়ে ফেলেছেন। বিষয়টিকে জাতীয় সংকট আখ্যা দিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নওগাঁর ছয়টি আসনেই জয়লাভ করেছিল ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এ বছরের শেষে কিংবা আগামী বছরের শুরুতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ নির্বাচনে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের সম্পৃক্ত করতে এবার স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে বেগ পেতে হতে পারে।
সরেজমিন ঘুরে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে থাকায় ভোটাধিকার সম্পর্কে তারা মোটেও সচেতন নন। তাদের পক্ষে যোগ্য প্রার্থী যাচাই করাও সম্ভব হয়ে ওঠে না। নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলেও এই জনগোষ্ঠীর সদস্যরা তাদের দাবি নিয়ে সোচ্চার হতে পারেন না।
জেলার পত্নীতলা উপজেলার পত্নীতলা ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের মথুরাপুর গ্রামে ওরাওঁ, পাহান ও মাহাতো জাতিসত্তার প্রায় ৪ হাজার নাগরিকের বসবাস। এখানে সরকারি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বিদ্যালয়ে যেতে হলে অন্তত তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে স্থানীয় জাতিগোষ্ঠীর বাসিন্দাদের উদ্যোগে ১৯৯১ সালে এই গ্রামে মাটির দুটি কক্ষ নির্মাণ করা হয়। এখানে বেসরকারিভাবে শিশুদের পাঠদান করানো হলেও গত কয়েক বছর ধরে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে।
এই গ্রামের বাসিন্দা শিরিশ তপ্য বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় শিশুদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়ছে। প্রতিবার নির্বাচনে এলেই স্কুল নির্মাণের দাবি জানানো হয়। প্রার্থীরা প্রতিশ্রুতিও দেন কিন্তু কেউ কথা রাখেন না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় এখানে খোলা মাঠে অস্থায়ী ভোটকেন্দ্র তৈরি করে ভোট নেওয়া হয়। ভোটের পর জনপ্রতিনিধিদের তারা আর পাশে পান না। ফলে ভোট নিয়ে এই গ্রামের আদিবাসীদের মধ্যে আর কোনো উৎসাহ দেখা যায় না।
মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর আদিবাসী পল্লি বর্তমানে ‘আলফ্রেড সরেন পাড়া’ হিসেবে পরিচিত। ২০০০ সালের আগেও এ মহল্লায় ৩০টির অধিক সাঁওতাল পরিবার বাস করতো। একের পর এক হুমকি, হত্যা ও নির্যাতনের কারণে গত ২৩ বছরে গ্রামটি প্রায় সাঁওতাল শূন্য হয়ে পড়েছে। ২০০০ সালের ১৮ আগস্ট এ গ্রামে তাণ্ডব চালিয়ে আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেনকে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ১১টি পরিবারের বাড়িঘর ভাঙচুর লুটপাটসহ অগ্নিসংযোগ করে রাজনৈতিক লেবাসধারী সন্ত্রাসীরা। আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের ২৩ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো এই হত্যা মামলার কোনো সুরাহা হয়নি। বর্তমানে সেখানে ১২টি পরিবার নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বসবাস করছে।
আলফ্রেড সরেনের ছোট ভাই মহেশ্বর সরেন বলেন, এখানকার কয়েক কোটি টাকার ভিপি সম্পত্তির উত্তরাধিকারী ছিল ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা। সেই জমি বেদখলের প্রতিবাদ করতে গিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের তোপের মুখে পড়েছিলেন তারা। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় আলফ্রেড সরেনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
তিনি বলেন, সংসদ নির্বাচন এলেই রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা গ্রামে এসে নির্ধারিত প্রতীকে ভোট দিতে চাপ দেওয়া শুরু করেন। কথা না শুনলে হত্যার হুমকি দেওয়া হয় সাঁওতালদের। এজন্য বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থায় তাদের আস্থা নেই।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, নওগাঁ জেলার ১১টি উপজেলা ছয়টি সংসদীয় আসনে বিভক্ত। মোট ভোটার ২২ লাখ ১৩ হাজার ৬৮৮। পুরুষ ভোটার ১১ লাখ ৪ হাজার ৭৩৩ এবং নারী ১১ লাখ ৮ হাজার ৯৫৩। এ ছাড়া ২ জন হিজরা ভোটার রয়েছেন। এখানে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ভোটারের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নির্বাচন কমিশনের সংগ্রহে নেই। সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী নওগাঁয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী রয়েছেন ১ লাখ ৭ হাজার ২৯২ জন। তবে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের তথ্যমতে, নওগাঁয় ২৯টি জাতিসত্তার দেড় লক্ষাধিক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ভোটার রয়েছেন। সেই অনুপাতে জেলায় প্রায় তিন লক্ষাধিক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। ২৯টি জাতিসত্তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হারে রয়েছে ওরাওঁ, মাহাতো, মুন্ডা, সাঁওতাল, পাহান, তুড়ি ও মাহালী।
নওগাঁ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের ভোটারদের ভোটাধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করবে নির্বাচন কমিশন। এ ছাড়া নির্বাচনের সময় ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সাপাহার উপজেলার জামান নগর গ্রামে অর্ধশতাধিক তুড়ি ও ওরাওঁ সম্প্রদায়ের পরিবারের বসবাস। স্থানীয়দের কাছে গ্রামটি তুড়িপাড়া হিসেবে পরিচিত। সেখানকার বাসিন্দা সুদাম সিংহ, আদরী ওরাওঁ, জৌতিষ ওরাওঁ’সহ অনেকেই বলেন, আদিবাসীরা বাঁচলেও আওয়ামী লীগ, মরলেও আওয়ামী লীগ। তবে টানা ১৫ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার পরেও আমাদের ভাগ্যের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে আদিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচনকালীন সময়ে যে-সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা পূরণ করতে পারলেই আদিবাসীদের মাঝে আবারও ভোটাধিকার প্রয়োগের আগ্রহ ফিরে আসবে।
নওগাঁ পৌরসভার চকবাড়িয়া মহল্লায় ৩০টি পরিবার নিয়ে দুই শতাধিক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস। যেখানে সদর উপজেলায় ভোটার হিসেবে জাতীয় পরিচয়পত্রধারী রয়েছেন অন্তত ১০০ জন। এই মহল্লার বেশিরভাগ নারীপুরুষই কৃষি শ্রমিকের পেশায় রয়েছেন। ভোর হলেই তারা ছুটে বেড়ান কাজের সন্ধানে। শহরে থেকেও তাদের ভাগ্যে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে বিগত নির্বাচনে তাদের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে ৯০ বছর বয়সী বাবু লাল ওরাওঁ বলেন, নির্বাচন না এলে জনপ্রতিনিধিদের পা আদিবাসী পায়ায় পড়ে না। নানান প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট আদায় করেন। ভোট শেষে পাঁচ বছর নেতাদের দেখা মেলে না। চিকিৎসা সহায়তাও দেওয়া হয় না। অথচ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা সবক্ষেত্রে প্রাধান্য পাচ্ছে। তাই ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার মতো আগ্রহ কারোরই নেই।
চকবাড়িয়া মহল্লার আরেক বাসিন্দা কার্তিক ওরাওঁ বলেন, আমরা সব দলের নেতাদের কাছে ভোট ব্যাংকের মতো। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের নেতারাই ভোটের আগে এসে নানান ভয়ভীতি দেখান। ভোট দিতে না গেলে ১ থেকে ২ বছর জেল খাটানোর হুমকি দেওয়া হয়। তাই ভোট দেওয়াকে সরকারি নিয়ম জেনে বাধ্য হয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে হয়।
নওগাঁ-২ (পত্নীতলা-ধামইরহাট) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য শহিদুজ্জামান সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, জনগণের ভোটে চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছি। আমার সময়ে এখানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য কালচারাল একাডেমি নির্মাণ করা হয়েছে। এটা আদিবাসীদের জন্য একটা স্বীকৃতি বলা চলে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে আদিবাসীরা সুখে আছে। যেকোনো দাবি উপস্থাপনে সরাসরি আদিবাসীরা আমার কাছে আসতে পারেন।
৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নওগাঁ-২ (পত্নীতলা-ধামইরহাট) আসনে বিজয়ী হয়েছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির কৃষি বিষয়ক সম্পাদক সামসুজ্জোহা খান। টানা তিন বার নির্বাচিত হয়েও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবনমান পরিবর্তনে কী ভূমিকা রেখেছেন জানতে চাইলে সাবেক এই সংসদ সদস্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, আদিবাসীদের ভোটেই বারবার নির্বাচিত হয়েছি। সকল নাগরিক সুবিধা বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর মতোই তারাও সমানভাবে পেয়েছেন। যা বর্তমান সময়ে তারা পাচ্ছেন না। আগামীতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তাদের জীবনমান উন্নয়নে আরও উদ্যোগ নেওয়া হবে।
মহাদেবপুর উপজেলার চেরাগপুর ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী ইউপি সদস্য মুক্তি পাহান। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্য হয়েও কীভাবে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাজনৈতিক অঙ্গনে তার পক্ষে লড়াই করাটা সত্যিই চ্যালেঞ্জিং ছিল। ইউপি নির্বাচনে অংশ নিতে গিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীসহ প্রতিপক্ষ প্রার্থীদের অনেক হুমকি ধামকির শিকার হতে হয়েছে। আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় এখানে আমি জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিলাম। তাই সব বাঁধা পেরিয়ে নির্বাচিত হতে পেরেছি।
ক্ষুদ্র জাতীগোষ্ঠীদের অধিকার রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) নরেন পাহান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভোটার হয়েও আদিবাসীরা প্রতিনিয়ত তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। নির্যাতন ও হত্যা করা হচ্ছে। অথচ হত্যাকারীদের বিচার হচ্ছে না। সংবিধান অনুযায়ী আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় আইন থাকলেও সেই আইনের প্রয়োগ নেই। তাই দীর্ঘ বছর ধরে বৈষম্যের শিকার হওয়ায় নির্বাচন নিয়েও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মাঝে কোনো আগ্রহ নেই। আগামী নির্বাচনে তাদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত করানো নির্বাচন কমিশনের জন্য কঠিন হবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম মাহমুদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুধু আদিবাসীদের ক্ষেত্রে নয়। বর্তমান সময়ের জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হওয়ার পর ভোটারদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভুলে যান। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না থাকায় ভোট প্রয়োগের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন ভোটাররা। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের কয়েকটি উপনির্বাচনের ফলাফল তার প্রমাণ। ভোটাধিকার প্রয়োগে আগ্রহ হারানোর জন্য বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থাই দায়ী। এটি এখন জাতীয় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিরোধী দলগুলোকে নিয়ে সংলাপে বসতে সরকারকে চাপ প্রয়োগ করাসহ ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন আয়োজন করতে না পারলে পরিবর্তন আসবে না। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে সবার আগে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।