দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে বেসামাল আর্জেন্টিনায় যেভাবে চলছে মানুষ

বিবিসির প্রতিবেদক ভ্যালি ফনটেইনি আর্জেন্টিনার পাঁচ জন বাসিন্দার সাথে কথা বলেছেন ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে তারা যেসব কৌশল ব্যবহার করছেন তা জানতে।

দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে বেসামাল আর্জেন্টিনায় যেভাবে চলছে মানুষ

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: অর্থনৈতিক বিপর্যয় আর্জেন্টিনার বাসিন্দাদের জন্য নতুন কিছু নয়, গত কয়েক দশকে তারা বহুবার অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করেছে। কিন্তু যখন মুদ্রাস্ফীতির হার ১০০ শতাংশের বেশি বেড়েছে এবং আর্জিন্টিনার মুদ্রা পেসোর মূল্য কমছে, তখন সংকট জর্জরিত মানুষ তাদের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। কারণ জিনিসপত্রের দাম খুব দ্রুত বাড়ছে এবং এর কারণে জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়ে গেছে। বিবিসির প্রতিবেদক ভ্যালি ফনটেইনি আর্জেন্টিনার পাঁচ জন বাসিন্দার সাথে কথা বলেছেন ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে তারা যেসব কৌশল ব্যবহার করছেন তা জানতে।

১. এখন কেনা, পরে দাম পরিশোধ

আর্জেন্টিনায় গত ৩০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মুদ্রাস্ফীতির হার ১০০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এর মানে হচ্ছে, ভোগ্যপণ্যের দাম গত মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। অর্থাৎ বিশেষ কোনো পণ্য বা নিত্যকার কোনো পণ্য কেনার জন্য টাকা জমানোর মানে হচ্ছে কয়েক মাস বা সপ্তাহ পর ওই পণ্যটি আরো বেশি দামে কিনতে হবে। তাহলে উপায়? এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে সুদমুক্ত ক্রেডিট কার্ড। বুয়েন্স আয়ার্সের বাসিন্দা মনিকা যিনি একজন ডিজিটাল আর্টিস্ট তার কৌশলটি হচ্ছে আজ কেনা, পরে দাম পরিশোধ করা।

২৭ বছর বয়সী মনিকা সুদ মুক্ত ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের এই সুযোগটি নিয়ে থাকেন; যা অনেক সুপারমার্কেট এবং কাপড়ের দোকান দিয়ে থাকে। তিনি বলেন, আমি সব কিছু সুদ-মুক্ত কিস্তিতে কিনি। কিস্তিগুলো সাধারণত তিন মাস বা এর কিছু বেশি মেয়াদী হয়ে থাকে। 

তাই মনিকার কাছে ২০ হাজার পেসো মূল্যের কোনো এক জোড়া জুতা কেনার মতো অর্থ না থাকলেও সে এটি পাঁচ হাজার পেসো করে কিস্তিতে কেনার চেষ্টা করবে। কারণ ২০ হাজার পেসো জমিয়ে কয়েক মাস পর কিনতে গেলে ওই জুতার দাম যখন ২৫ হাজার পেসো হয়ে যাবে সেই ঝুঁকি নিতে চায় না সে। ‘আমি যদি কিস্তিতে কোনো কিছু কিনতে না পারি, তাহলে সাধারণত আমি তা কিনি না,’ বলেন তিনি।

২. বিনিময় করুন

যেহেতু পণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যাচ্ছে তাই আর্জেন্টিনার অনেক বাসিন্দার হাতে মাস শেষে আর কোনো অর্থ অবশিষ্ট থাকে না যা দিয়ে মৌলিক চাহিদা মেটানো যায়। টেরেসা, যিনি মার ডেল প্লাটা শহরে একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী, তিনি তার বেশিরভাগ আয় ঘর ভাড়ায় ব্যয় করেন। তার দ্বিতীয় সবচেয়ে বড় ব্যয় হয়, সে যে বাড়িগুলোতে কাজ করে সেখানে যাতায়াতে। প্রতিদিন কমপক্ষে চার ঘণ্টা গণপরিবহনে কাটাতে হয় তাকে। এরপর তার আয়ের যৎসামান্যই বাকি থাকে এবং তার হাতে অবসর সময়ও খুব বেশি থাকে না। তাই ৩১ বছর বয়সী এই নারীর হাতে অর্থ বাড়ানোর মতো খুব বেশি বিকল্প থাকে না।

তিনি বলেন, আমার হাতে পেসো না থাকলে, আমি বিনামূল্যে যানবাহন ব্যবহারের চেষ্টা করি অথবা হাঁটি। কিন্তু অন্য সব খরচের কী হবে? টেরেসা বলেন, যে তার মতো একই অবস্থায় আছে এমন মানুষ খুঁজে বের করাটা তাকে নগদ খরচ কমাতে সাহায্য করেছে। ‘আমি একটি ক্লাবে যোগ দিয়েছি যেখানে মানুষ জিনিসপত্র অদল-বদল করে। গত সপ্তাহে আমি এক জোড়া জুতার পরিবর্তে আমার এক খদ্দেরের কাছ থেকে দুধ, টুথপেস্ট, রুটি এবং অন্য খাবার নিয়েছি।’

৩. একসাথে একই পণ্য বেশি করে কেনা

কিন্তু এরপরও মাস শেষে যাদের হাতে কিছুটা অর্থ বাকি থাকে, আকাশ ছোঁয়া মুদ্রাস্ফীতি তাদের জন্য সমস্যা তৈরি করছে। মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ এতো বেশি হওয়ার মানে হচ্ছে আপনি সঞ্চয় করলেও তা দ্রুতই মূল্য হারাবে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যদি আপনি আপনার সেভিংস অ্যাকাউন্টে এক লাখ পেসো জমা রাখেন, তাহলে এক বছর পর আপনি এক লাখ পেসোর সাথে আরো কিছু মুনাফা পাবেন। কিন্তু সুদের হারের তুলনায় মুদ্রাস্ফীতি যেহেতু বেশি, তাই আপনার পেসো এক বছর পর বর্তমান সময়ে তুলনায় মূল্য হারাবে।

তাহলে মাস শেষে যে অর্থ বেঁচে যাচ্ছে, সেটা দিয়ে আর্জেন্টিনার বাসিন্দারা কী করছে? নইরা নামে মেনডোজা শহরের বাসিন্দা, যিনি একজন নার্স। তিনি বলেন, তিনি এমন পরিমাণ পণ্য বেশি পরিমাণে কেনার চেষ্টা করেন যা পঁচে যাবে না। ‘আমি আমার বেতনের মূল্য যাতে কমে না যায় তা নিশ্চিত করতে নষ্ট হয় না এমন পণ্য যেমন কফি, টয়লেট পেপার; এগুলো বেশি পরিমাণে কেনার চেষ্টা করি,’ বলেন ৫৯ বছর বয়সী এই নারী।

তিনি এসব পণ্য তার ফ্লাটের একটি কক্ষে জমা করেন এবং অতিরিক্ত পণ্য তার বন্ধু বা সহকর্মীদের কাছে বিক্রি করেন। পেসোর দাম এতো পরিবর্তনশীল হওয়ার কারণে তিনি তার জমা করা পণ্যগুলোকে ডলারের সাথে বিনিময় করার চেষ্টা করেন। মার্কিন ডলার বিনিয়োগের জন্য তুলনামূলক নিরাপদ। সত্যি বলতে পেসোর বিপরীতে ডলারের দাম ব্যাপকভাবে বাড়ছে। এপ্রিলে একদিন ডলারের দাম ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ৭ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল।

৪. ডলার ক্রয়

যদিও পেসো আর্জেন্টিনার জাতীয় মুদ্রা তারপরও নইরার মতো অনেক আর্জেন্টাইনের এই মুদ্রার ওপর আস্থা নেই এবং এ কারণে হাতে থাকা অতিরিক্ত পেসোকে তার ডলারে রূপান্তর করতে চান। বাণিজ্যের শিক্ষার্থী ২৩ বছরের ইয়র্গ, তার শুধু পেসোর পরিবর্তে ডলারে ওপর আস্থা বেশি তাই নয়, বরং আর্জেন্টিনার ব্যাংকের ওপরও তার বিশ্বাস নেই এবং এ কারণে তিনি ডলার নিজের বাড়িতে রাখতেই পছন্দ করেন। ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর তার অনাস্থা ২০০১ সালের আর্জেন্টিনার সংকটের সময় তার পরিবারের অভিজ্ঞতার কারণেই হয়েছে। তখন আর্জেন্টিনার বাসিন্দারা ব্যাংক থেকে কী পরিমাণ অর্থ তুলতে পারবে তা সীমিত করে দিয়েছিল।

ব্যাংক ধসে পড়ে এবং সেই সাথে মানুষের সারা জীবনের সঞ্চয়ও চিরতরে হারিয়ে যায়। ইয়র্গের বাবা প্রায় ৬০ হাজার মার্কিন ডলার হারান। ‘ব্যাংক যখন দেউলিয়া হয়ে গেল এবং আমাদের অর্থ দিতে পারলো না, তখন আমাদেরকে বাড়ি বিক্রি করে দিতে হয়েছিল,’ তিনি স্মৃতিচারণ করেন। এর ২০ বছরেরও বেশি সময় পর তার মতো আরো অনেক আর্জেন্টাইন নিজেদের সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকের ওপর ভরসা করতে পারে না। ‘ব্যাংকে অর্থ রাখতে আমি প্রচণ্ড ভয় পাই, তাই আমার হাতে অতিরিক্ত আয় থাকলে আমি সেটা দিয়ে মার্কিন ডলার কিনে রাখি।’

কিন্তু আর্জেন্টিনায় ডলার কেনাটা খুব একটি সহজ কাজ নয়। সরকার আর্জেন্টাইনদের ডলার কেনা সীমিত করে দিয়েছে। দেশটির একজন বাসিন্দা প্রতি মাসে ২০০ ডলারের বেশি ডলার ব্যাংক কিংবা এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর কাছ থেকে কিনতে পারবে না। সরকারের সীমিত ডলারের মজুদ যাতে কমে না যায় সেটি ঠেকাতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

এসব কারণেই অনানুষ্ঠানিক বাজার গড়ে উঠেছে যেখানে মার্কিন ডলারকে ব্লু বা নীল ডলার বলা হয় এবং সেখানে অনেক বেশি দামে ডলার কেনাবেচা হয়। যদিও এটা অবৈধ তারপরও ইয়র্গের মতোই আর্জেন্টিনার অনেক বাসিন্দা বিদেশি মুদ্রার নাগাল পেতে এটি প্রয়োজন বলে মনে করেন।

তিনি বলেন, ডলার কেনাটা সস্তা নয়, কারণ আমাদের বেশিরভাগই উচ্চমূল্যের ‘ব্লু’ ডলার রেটে কিনতে হয়। গত ৩০ এপ্রিল ইয়র্গ অনানুষ্ঠানিক বাজারে এক ডলারের বিনিময়ে ৪৬৯ পেসো পর্যন্ত দাম দিয়েছেন। কিন্তু তিনি মনে করেন যে, ডলারে বিনিয়োগ করাটা যৌক্তিক, কারণ এটি পেসোর মতো মূল্য হারাবে না।

৫. খরচ, খরচ, খরচ

কিন্তু ব্লু ডলার এবং পেসোর বিনিময় হার বেশি হওয়ার কারণে আর্জেন্টিনার অনেক বাসিন্দা ডলারকে নিরাপদ বিনিয়োগ মনে করলেও সেটি কেনার প্রতি জোর দেন না। ‘ডলার কেনার মতো অর্থ নেই আমার কাছে এবং আমার হাতে থাকা অবস্থাতেই পেসোর মূল্য কমছে,’ ২৫ বছর বয়সী দোকানের একজন সহকারী রবার্টা বলেন। সতাই নিজের অতিরিক্ত অর্থের মূল্য কমা দেখার চেয়ে তিনি তার আয়ের পুরোটাই ‘যত দ্রুত সম্ভব’ ব্যয় করে ফেলতে চান।

প্রতি মাসে পণ্যের দাম ৬-১০ শতাংশ বাড়ছে, এটা ব্যাপক হারে বাড়ছে। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতির কারণে তিনি তার আয় করা পেসোর বিনিময়ে প্রতি মাসেই কিছু কম পণ্য কিনতে পারেন। তিনি বলেন, প্রতি মাসেই আমি আগের মাসে যা কিনেছিলাম সেই পরিমাণ পণ্য কিনতে পারি না। বিবিসি বাংলা।