ঢাকায় ১৬ মাসে ২২৪ খুন, বেশি ওয়ারী-মিরপুরে
রাজধানীতে প্রতি মাসে গড়ে এ ধরনের খুনের ঘটনা ঘটে ১৩ থেকে ১৫টি। অধিকাংশ খুনের কারণ মাদক, ছিনতাই, পারিবারিক নির্যাতন ও।
প্রথম নিউজ, ঢাকা: দীর্ঘদিন পরিবারসহ যাত্রাবাড়ীর মীর হাজিরবাগ এলাকায় বসবাস করতেন শাওন নামে এক ব্যক্তি। টিকাটুলীর একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি করার পাশাপাশি জড়িত ছিলেন মাদক কারবারে। শুভ নামে একজন বন্ধু ছিল শাওনের। শুভর সঙ্গে আবার রজব নামে এক ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। একদিন মাদক নিয়ে ঝামেলার কারণে তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা ও হাতাহাতি হয়। বিষয়টি রজব তার বড় ভাই মিজানকে জানায়। শাওনকে ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়ার পরিকল্পনা করেন মিজান। পরে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর মীর হাজীরবাগ এলাকায় খুন হন শাওন।
রাজধানীতে প্রতি মাসে গড়ে এ ধরনের খুনের ঘটনা ঘটে ১৩ থেকে ১৫টি। অধিকাংশ খুনের কারণ মাদক, ছিনতাই, পারিবারিক নির্যাতন ও। ব্যক্তিগত শত্রুতা। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালে রাজধানীতে ১৭৩টি খুনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ৯৭ শতাংশ খুনের ঘটনাই অরাজনৈতিক। ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত রাজধানীতে ৫১টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৫০টি খুনের ঘটনাই অরাজনৈতিক। নগরজুড়ে ঘটা এসব খুনের প্রায় ৪০ শতাংশই হয় ওয়ারী ও মিরপুর অঞ্চলে। বাকি সব এলাকা মিলে হয় ৬০ শতাংশ।
গত বছরের ২৭ মার্চ মাসে রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন গরিবের ডাক্তার খ্যাত মগবাজারে রংপুর ডেন্টাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের দন্ত চিকিৎসক ডা. আহমেদ মাহী বুলবুল। সেখানে দরিদ্র ও নিম্নবিত্তদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া বুলবুল খুন হন ছিনতাইকারীর হাতে।
চলতি বছরের ২ এপ্রিল রাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে রিকশা ছিনতাই করার জন্য দুই ছিনতাইকারী একটি অটোরিকশা ভাড়া করেন। অটোরিকশাটি ডেমরা থানার আমুলিয়া মডেল টাউনে নির্জন জায়গায় যাওয়ার পর পিছন আসা আরও দুই ছিনতাইকারীসহ চার ছিনতাইকারী মিলে ইট দিয়ে রিকশাচালকের মুখ, চোখ ও মাথায় আঘাত করেন। পরে গলায় ফাঁস দিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করেন চালককে। এর মাসখানেত আগেও একই জায়গায় একই পদ্ধতিতে আরেক রিকশাচালককে হত্যা করে রিকশা ছিনতাই করে এই চক্র।
চলতি মাসের ১৩ জুন রাতে রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় অর্কিড জামশেদ টাওয়ারের বাসা থেকে মাহমুদা হক বৃষ্টি ও মেয়ে সানজা মারওয়ার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ হত্যার দায়ে বৃষ্টির স্বামী সেলিমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পারিবারিক কলহ, অশান্তির জেরে পরিকল্পিতভাবে দুধের সঙ্গে ৩০টি ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে স্ত্রী ও মেয়েকে খাওয়ান সেলিম। এতে দুজনের মৃত্যু হয় বলে ধারণা পুলিশের। পারিবারিক কলহে হত্যার শিকার হওয়া মাহমুদা হক বৃষ্টির মামা সোহেল শিকদার বলেন, প্রায় ১৪ বছর আগে তাদের বিয়ে হয়। তার স্বামী সেলিম বিয়ের পর গোপনে আরও তিন থেকে চারটি বিয়ে করেছে। এগুলো জানাজানি হলে এসব নিয়ে আমার ভাগ্নির সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া, অশান্তি শুরু হয়। এর জেরেই তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।
রাজনৈতিক খুনের সংখ্যা কম, আলোচনা বেশি
গত বছরের ২৪ মার্চ রাত সোয়া ১০টার দিকে রাজধানীর শাহজাহানপুরের আমতলী এলাকায় ঢাকার মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে (৫৪) গুলি করে হত্যা করা হয়। এসময় তার গাড়ির পাশে রিকশায় থাকা বদরুন্নেছা সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী সামিয়া আফনান প্রীতিও গুলিতে নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হন টিপুর গাড়িচালক মুন্না। দেশব্যাপী আলোচনার ঝড় তোলে এ হত্যাকাণ্ড।
গত বছরের আগস্টে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর শহীদ ফারুক সড়কে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে নিহত হন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা মোহাম্মদ আবু বক্কর সিদ্দিক। নিহতের ভাই মো. সুমন দাবি করেন, এলাকার চিহ্নিত চাঁদাবাজরা তার ভাইকে হত্যা করেছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালে রাজধানীতে ১৭৩টি খুনের মধ্যে শুধু রাজনৈতিক কারণে খুনের ঘটনা তিনটি। ২০২৩ সালে ৫১টি খুনের মধ্যে রাজনৈতিক কারণে খুনের ঘটনা ঘটেছে একটি। রাজনৈতিক এসব হত্যাকাণ্ডের বেশিরভাগই হয় আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার হায়াতুল ইসলাম বলেন, খুন-হত্যার ঘটনা মাদক, ছিনতাই বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক না কেন গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হয়। আলোচিত বা চাঞ্চল্যকর খুন-হত্যার ক্ষেত্রে বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে আমরা অপরাধীকে দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করি। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, রাজধানীসহ দেশের যেখানেই খুন, হত্যাকাণ্ড ঘটে তার কারণ খুঁজে বের করে অপরাধীকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করি। এসব খুন, হত্যার পিছনে মাদক, ছিনতাই, পারিবারিক কলহসহ নানা কারণ থাকে। তবে কারণ যাই হোক অপরাধীকে দ্রুত আইনের আওতায় আনাই আমাদের লক্ষ্য থাকে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) ড. খ: মহিদ উদ্দিন বলেন, রাজধানীতে খুন, হত্যাসহ যে কোনো অপরাধ সংঘঠিত হলে আমরা ব্যবস্থা নেই। মাদক, ছিনতাই, রাজনৈতিক আধিপত্য বা যে কোনো তুচ্ছ ঘটনায় খুনের ঘটনা ঘটলে এর সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, নানা কারণে পরিবার ও সমাজে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। পরিবারে বিশ্বাসের জায়গায় যখন কেউ শতভাগ পূরণ করতে না পারে বা প্রত্যাশিত মাত্রা অর্জন করতে না পারে তখনই পরিবারিক কলহ এবং খুনের মতো ঘটনা ঘটে। এছাড়া মাদক, ছিনতাই, পারিবারিক কলহ, ক্ষমতা প্রদর্শন, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা বিষয় কেন্দ্র করেও খুনের ঘটনা ঘটে।
পরিবার ও সমাজে খুন, হত্যাসহ অপরাধ কমানোর বিষয়ে তিনি বলেন, পরিবারে সম্পর্কের জায়গায় বিশ্বাসটা অক্ষুণ্ন রাখার পাশাপাশি যে কোনো ধরনের মাদক থেকে পরিবারের সদস্যটিকে দূরে রাখতে হবে। আর সমাজে যেন কোনো ধরনের অস্থিরতা তৈরি না হয় তার জন্য সরকারকে সব বিষয়ের ওপর নজর দিতে হবে যাতে কেউ অপরাধের দিকে ধাপিত হতে না পারে। ‘এছাড়া রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক যে কোনো ধরনের ক্ষমতাই হোক না কেন তা যেন অবৈধভাবে প্রয়োগ না করা হয়। সেটা নিশ্চিত করা ও অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলে খুন, হত্যাসহ যে কোনো ধরনের অপরাধই কমে যাবে।’