ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ৬২ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ
ঘটছে দুর্ঘটনা, হচ্ছে প্রাণহানি
প্রথম নিউজ, ঢাকা: দেশের লাইফ লাইন হিসেবে পরিচিত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ৬২ কিলোমিটার এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রায়ই ওই সড়কের কোনো না কোনো অংশে ঘটছে দুর্ঘটনা। ঝরছে তরতাজা প্রাণ। পঙ্গু হয়ে অভিশপ্ত জীবন কাটাচ্ছে অনেকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মহাসড়কের মিরসরাই উপজেলার ধুমঘাট থেকে সীতাকুণ্ড উপজেলার সিটিগেট পর্যন্ত অংশে সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছে না। দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ তিন চাকার বিভিন্ন যান চলাচল নিষিদ্ধ করাসহ গতিরোধক, সড়ক চারলেনে উন্নীতকরণ, একাধিক পয়েন্টে পথচারী পারাপারে ওভারব্রিজ স্থাপন করেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।
মহাসড়কের ওই অংশে ঘটা দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে গত ২০ সেপ্টেম্বর মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া এলাকায় এশার নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরার পথে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় প্রাণ হারান আজিজুর রহমান এমানি (৬০) নামে এক ব্যবসায়ী। এরপর ২৫ সেপ্টেম্বর সীতাকুণ্ডে দেওয়াল ভেঙে এতিমখানার ভেতরে ট্রাক ঢুকে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে এতিমখানার ১২ ছাত্রসহ ১৩ জন আহত হন।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর সকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাই উপজেলার ইছামতি এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি মাইক্রোবাস কালভার্টের সঙ্গে ধাক্কা লেগে মো. জাহিদ ইকবাল (৪৬) নামে পুলিশের এক পরিদর্শক নিহত হয়েছেন। তিনি চুয়াডাঙ্গা জেলা পুলিশের বিশেষ শাখায় কর্মরত ছিলেন। একই দুর্ঘটনায় তার সন্তানসহ আরও সাতজন আহত হয়েছেন। তারা ওইদিন বান্দরবান যাচ্ছিলেন। আর ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড উপজেলার দারগারহাট এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় এক নারী নিহত হয়েছেন।
এছাড়া ৩ অক্টোবর মিরসরাইয়ের চৈতন্যারহাট ও নয়দুয়ারিয়া এলাকায় পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় একজন নিহত ও আটজন আহত হয়েছেন। ১৮ অক্টোবর সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাটে সড়ক দুর্ঘটনায় নুসরাত জাহান তুলী নামে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (আইআইইউসি) এক শিক্ষার্থী আহত হন। পরে ২০ অক্টোবর ভোরে নগরীর সিএসসিআর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পথচারীদের অসচেতনতা, চোখে ঘুম নিয়ে গাড়ি চালানো, সড়ক ঘেঁষে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা, ওভারটেক, অবৈধ পার্কিং, পথচারী ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার না করা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। সড়কের ধুমঘাট থেকে চট্টগ্রাম শহরের সিটিগেট পর্যন্ত বিভিন্ন ফিলিং স্টেশন, রেস্টুরেন্ট ও কয়েকটি শিল্প কারখানার সামনে সড়কের ওপর গাড়ি পার্কিংয়ের কারণেও ঘটছে দুর্ঘটনা। প্রায় সময় গাড়ি পার্কিং করে চালক ও তাদের সহকারীরা বাইরে আড্ডা দেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতাপূর্ণ ওভারটেকিং প্রবণতা, মহাসড়কে নির্ধারিত গতিসীমা উপেক্ষা করে বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানো, মাদকাসক্ত হয়ে গাড়ি চালানো ও অদক্ষ চালক দিয়ে বিরামহীনভাবে গাড়ি চালনা এসব দুর্ঘটনার জন্য প্রধানত দায়ী। এছাড়া মহাসড়ক পারাপারে পথচারীদের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতিও রয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, সড়ক ব্যবস্থাপনায় রাস্তাঘাটে যদি শৃঙ্খলা ফিরে না আসে, যানবাহন চলাচলে সুসংগঠিত ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে মালিক আর চালকদের মধ্যে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা কাজ করে তা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। মহাসড়কে ধীরগতিতে চলা যানবাহনের কারণে ওভারটেকিং বাড়ে। যানবাহনের মালিকরা অতিরিক্ত আয় এবং ব্যাংক ঋণ দ্রুত পরিশোধ করার তাড়নায় চালকদের ওপর বাড়তি আয়ের চাপ দেন। সামগ্রিক পরিবহন ব্যবস্থাপনায় যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা দূর করতে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
তবে মাদারবাড়ি-বারইয়ারহাট রুটে চলাচলকারী চয়েস বাস মালিক সমিতির সভাপতি অব্দুর রহিম দাবি করেন, চালকদের অধিক আয়ের জন্য চাপ দেন- এমন মালিকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তিনি বলেন, শুধু কঠোর আইন করে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। সবার মধ্যে সচেতনতা যদি না বাড়ে তাহলে শুধু আইন দিয়ে কোনো লাভ হবে না। পথচারীদের অসচেতনতার কারণেও দুর্ঘটনায় প্রাণহানির হার কম নয়। তাই চলতি পথে সবার সচেতনতা ও আইন মেনে চলা দুটোরই প্রয়োজন রয়েছে।
জোরারগঞ্জ হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোহেল সরকার বলেন, বেপরোয়া গতি বা উল্টোপথে গাড়ি চালানোসহ ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে আমরা প্রায় অভিযান চালিয়ে থাকি। অনেক গাড়িকে মামলা দেওয়া হয়। তারপরও তারা সচেতন হয় না। চালক, পথচারী যদি আরও বেশি সচেতন হয় তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে।