জনসংখ্যার এক শতাংশও নেই স্বাস্থ্য বিমার আওতায়

বিপদের সময় বন্ধুর মতো পাশে দাঁড়ালেও দেশের মানুষকে খুব একটা টানতে পারছে না স্বাস্থ্য বিমা। দেশের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশও এই বিমার আওতায় নেই।

জনসংখ্যার এক শতাংশও নেই স্বাস্থ্য বিমার আওতায়
ফাইল ফটো

প্রথম নিউজ, ঢাকা: বিপদ বলে কয়ে আসে না। মহামারি করোনাভাইরাস পরিস্থিতি বিষয়টি আরও ভালো করে শিখিয়েছে। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে সারাজীবনের সঞ্চয় কীভাবে এক ধাক্কায় শেষ হয়ে যেতে পারে, তা দেখেছে বহু পরিবার। এমন বিপদে কিছুটা হলেও শক্তি দিতে পারতো একটি স্বাস্থ্য বিমা। দেশে ব্যবসা করা সাধারণ ও জীবন- উভয় শ্রেণির বিমা কোম্পানিগুলো বিক্রি করছে এই স্বাস্থ্য বিমা পলিসি। বিপদের সময় বন্ধুর মতো পাশে দাঁড়ালেও দেশের মানুষকে খুব একটা টানতে পারছে না স্বাস্থ্য বিমা। দেশের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশও এই বিমার আওতায় নেই।

মানুষের সচেতনতার অভাব ও একচুয়ারি (বিমা পলিসি তৈরির বিশেষজ্ঞ) সংকটে বিমা কোম্পানিগুলো ভালো বিমা পলিসি চালু করতে না পারায় স্বাস্থ্য বিমার প্রতি মানুষ খুব একটা আগ্রহী হচ্ছেন না বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, একটি স্বাস্থ্য বিমা থাকলেই চিকিৎসা ব্যয় অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে এমনকি প্রতিবেশী ভারতেও স্বাস্থ্য বিমাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে স্বাস্থ্য বিমা সম্পর্কে মানুষের খুব একটা ধারণা নেই। তারা আরও বলছেন, বর্তমানে খুবই নগণ্য সংখ্যক মানুষ স্বাস্থ্য বিমার আওতায় আছেন। স্বাস্থ্য বিমার গ্রাহক সংখ্যা বাড়াতে একদিকে যেমন প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে, অন্যদিকে সরকার থেকেও আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতে হবে। প্রাথমিকভাবে স্বাস্থ্য বিমা পলিসির জন্য সরকার থেকে ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে।

সম্প্রতি স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে গিয়ে প্রতি বছর ৮৬ লাখের বেশি মানুষের আর্থিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে ১৬ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নেন না। এ হিসাবে প্রায় তিন কোটি মানুষ প্রয়োজন হলেও নিচ্ছেন না চিকিৎসা। এদিকে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) থেকে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটে পাঠানো এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে ব্যবসা করা বিমা কোম্পানিগুলোতে ১৫ লাখ ১২ হাজার ১২৪ জনের স্বাস্থ্য বিমা করা আছে। ২০২০ সালের তথ্য দিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। দুই বছর আগে অর্থাৎ ২০১৮ সালে স্বাস্থ্য বিমার আওতায় ছিল ২৮ লাখ ৯ হাজার ৩৫৯ জন। অর্থাৎ দুই বছরের ব্যবধানে স্বাস্থ্য বিমার আওতায় থাকা মানুষের সংখ্যা কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে।

দেশে বর্তমানে ৩৩টি জীবন বিমা কোম্পানি এবং ৪৬টি সাধারণ বিমা কোম্পানি ব্যবসা করছে। এর মধ্যে ১৬টি জীবন ও ১২টি সাধারণ বিমা কোম্পানি স্বাস্থ্য বিমা পলিসি বিক্রি করে। স্বাস্থ্য বিমার এই পলিসির মধ্যে রয়েছে গ্রুপ ও একক স্বাস্থ্য বিমা। গ্রুপ স্বাস্থ্য বিমার আওতায় আছেন ৯ লাখ ৫১ হাজার ৬৯ জন। আর একক স্বাস্থ্য বিমার আওতায় রয়েছেন ৫ লাখ ৬১ হাজার ৫৫ জন। দেশের মোট জনসংখ্যা ১৮ কোটি ধরলে মাত্র দশমিক ৮৪ শতাংশ স্বাস্থ্য বিমার আওতায় আছে।

জীবন ও সাধারণ- উভয় শ্রেণির বিমা কোম্পানি স্বাস্থ্য বিমা পলিসি বিক্রি করলেও জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর মাধ্যমেই বেশি পলিসি বিক্রি হচ্ছে। জীবন বিমা কোম্পানিগুলোতে ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৭৫০ জন একক এবং ৭ লাখ ৪৬ হাজার ২৮৪ জন গ্রুপ স্বাস্থ্য বিমার আওতায় আছেন। অন্যদিকে সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোতে ২৫ হাজার ৩০৫ জন একক এবং ২ লাখ ৪ হাজার ৭৮৫ জন গ্রুপ স্বাস্থ্য বিমার আওতায় আছেন। দেশে ব্যবসা করা বিমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষকে স্বাস্থ্য বিমার আওতায় নিয়ে এসেছে মেটলাইফ। বিদেশি মালিকাধীন এই জীবন বিমা কোম্পানিটিতে একক স্বাস্থ্য বিমার আওতায় আছেন ৫ লাখ ১২ হাজার ৪৮০ জন। আর গ্রুপ স্বাস্থ্য বিমার আওতায় আছেন ৮৩ হাজার ৬১৭ জন।

দেশীয় বিমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষকে গ্রুপ স্বাস্থ্য বিমার আওতায় নিয়ে এসেছে গার্ডিয়ান লাইফ। এই বিমা কোম্পানিটি ৩ লাখ ২৩ হাজার ৩০৭ জনকে গ্রুপ স্বাস্থ্য বিমার আওতায় নিয়ে এসেছে। অর্থাৎ জীবন বিমা কোম্পানিগুলোতে গ্রুপ স্বাস্থ্য বিমার আওতায় থাকা প্রায় অর্ধেকই রয়েছে গার্ডিয়ানে। তবে কোম্পানিটি থেকে এককভাবে কেউ স্বাস্থ্য বিমা পলিসি নেয়নি। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একক স্বাস্থ্য বিমার আওতায় সবচেয়ে বেশি মানুষ আছে ডেল্টা লাইফে। এই জীবন বিমা কোম্পানিটির একক স্বাস্থ্য বিমার আওতায় আছেন ১১ হাজার ৫৪৩ জন। আর গ্রুপ স্বাস্থ্য বিমার আওতায় আছেন ৮৮ হাজার ৫১ জন।

সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে গ্রুপ স্বাস্থ্য বিমার আওতায় সবচেয়ে বেশি মানুষকে নিয়ে এসেছে গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স। ১ লাখ ৬২ হাজার ৪২১ জনকে গ্রুপ স্বাস্থ্য বিমার আওতায় নিয়ে এসেছে এই সাধারণ বিমা কোম্পানিটি। প্রতিষ্ঠানটিতে একক স্বাস্থ্য বিমা আছে ১ হাজার ৪৮১ জনের। সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে একক স্বাস্থ্য বিমার আওতায় সবচেয়ে বেশি মানুষকে নিয়ে এসেছে রাষ্ট্র মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সাধারণ বিমা করপোরেশন। এই প্রতিষ্ঠানটিতে ১০ হাজার ৯২২ জনের একক স্বাস্থ্য বিমা আছে। তবে প্রতিষ্ঠানটিতে গ্রুপ স্বাস্থ্য বিমা নেই। বেসরকারি সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষকে একক স্বাস্থ্য বিমার আওতায় নিয়ে এসেছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স। এই বিমা কোম্পানিটিতে একক স্বাস্থ্য বিমা আছে ৮ হাজার ৩শ জনের। আর কোম্পানিটিতে গ্রুপ স্বাস্থ্য বিমা পলিসি আছে ৫ হাজার ৭২৫ জনের।

দেশের স্বাস্থ্য বিমা পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রগতি লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. জালালুল আজিম বলেন, আমাদের দেশে স্বাস্থ্য বিমার আওতায় থাকা মানুষের সংখ্যা খুবই কম। বাংলাদেশে এখন যে পলিসি বিক্রি হচ্ছে তা গ্রুপ স্বাস্থ্য বিমা। সত্যিকারের একক স্বাস্থ্য বিমা বাংলাদেশে তেমন একটা নেই। এককের সংখ্যা যদি না বাড়ানো যায়, শুধু গ্রুপ দিয়ে স্বাস্থ্য বিমা বাড়ানো যাবে না। সুতরাং, একক বিমা লাগবে। আর একক বিমা বাড়াতে হলে ভালো পলিসি লাগবে। ভালো বিমা পলিসি বানানোর মতো এক্সপার্ট (দক্ষ) লোক আমাদের কম। আমি একটা প্রোডাক্ট (পণ্য) বানাবো, একচুয়ারি নেই। তিনি বলেন, সত্যিকার অর্থে এই বিমা পণ্যটি আমাদের দেশে নতুন। এটার প্রচুর মার্কেটিং করতে হবে। সেই মার্কেটিং কার্যক্রম আমাদের খুব একটা নেই। প্রথম দিকে প্রচারের জন্য কিছু খরচ করতে হবে। আমাদের জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা খরচের সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। নতুন প্রোডাক্ট চালু করার ক্ষেত্রে অন্যরা (বাইরের দেশ) যেভাবে খরচ করে, আমাদের পক্ষে সেভাবে খরচ করার সুযোগ নেই। সুতরাং, আমরা চাইলেই প্রচার-প্রচারণা করতে পারছি না।

‘স্বাস্থ্য বিমার প্রিমিয়াম একটু বেশি হয়। এখানে কমিশন অন্য একক পলিসির মতো করা হয়, তাহলে গ্রাহকের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। আমরা যখন কম কমিশন দেই, তখন আমাদের বিক্রয়কর্মীরা কম অর্থ পায়। যে কারণে তারা স্বাস্থ্য বিমার বদলে অন্য বিমা পলিসি বেশি বিক্রি করতে চায়। জালালুল আজিম বলেন, স্বাস্থ্য বিমার প্রসার ঘটাতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। বিদেশে যেমন আছে, ভারতেও আছে। সরকার একটা প্রণোদনা দিয়ে তাদের স্বাস্থ্যসেবা দেয়। বাংলাদেশে এটা নেই। গরিব লোকজন অসুস্থ হলে সরকারি হাসপাতাল ছাড়া তাদের কোনো উপায় নেই।

জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সিইও এস এম নুরুজ্জামান বলেন, আমাদের দেশে স্বাস্থ্য বিমার সংখ্যা খুবই সামান্য। এর মূল কারণ একচুয়ারি সংকট। একচুয়ারি সংকটের কারণে ভালো পলিসি আসছে না। এটা বিমা সেক্টরের জন্য একটা বড় সমস্যা। আমরা এখন যে স্বাস্থ্য বিমা পলিসি বিক্রি করছি তা অন্য একটা জীবন বিমা পলিসির সঙ্গে সম্পূরক হিসেবে দিচ্ছি। ডেল্টা লাইফের কোম্পানি সচিব উত্তম কুমার সাধু বলেন, স্বাস্থ্য বিমা পলিসি কেনা একজন গ্রাহক যদি অসুস্থ হয়ে অথবা দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন, তাহলে পলিসির ধরন অনুযায়ী তার চিকিৎসার ব্যয় বহন করে বিমা কোম্পানি। স্বাস্থ্য বিমা পলিসি থাকলে চিকিৎসা ব্যয় অনেক কমে যায়। উন্নত বিশ্বে স্বাস্থ্য বিমাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে স্বাস্থ্য বিমা সম্পর্কে মানুষের তেমন ধারণা নেই। যে কারণে স্বাস্থ্য বিমার আওতা বাড়ছে না।