খেলাপি ঋণে ৪১ হাজার কোটি টাকার সুদ স্থগিত
এক বছরে ব্যাংকের আয় কমেছে ৬ হাজার কোটি টাকা
প্রথম নিউজ, ঢাকা: ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ার পাশাপাশি বাড়ছে আদায় অযোগ্য মন্দ ঋণ। বাংলাদেশ বাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, এক লাখ এক হাজার ১৪৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকাই আদায় অযোগ্য মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে। মন্দ ঋণ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি কমে যাচ্ছে ব্যাংকের সামগ্রিক আয়। গত সেপ্টেম্বর শেষে শুধু খেলাপি ঋণের বিপরীতে সুদ আয় স্থগিত করে রাখা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪১ হাজার কোটি টাকা, যা এক বছর আগে ছিল সাড়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবে ব্যাংকের এক বছরে আয় কমেছে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, প্রায় দুই বছর ধরে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে ঋণ আদায়ের ওপর শিথিলতা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ সময়ে কেউ ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলেও তাকে ঋণখেলাপি করা হয়নি। অর্থাৎ ঋণ নিয়মিত রাখা হয়েছে। কিন্তু আগামী ডিসেম্বরের পর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শিথিলতা উঠে যাবে। তখন একসাথে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের চাপ বেড়ে যাবে। আর খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে বেড়ে যাবে মন্দ ঋণ। আর এ মন্দ ঋণের কারণে ব্যাংকের আয়ের ওপরও বড় ধরনের প্রভাব পড়বে বলে ব্যাংকাররা আশঙ্কা করছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রচলিত নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ঋণ মন্দ মানের খেলাপি হলে ওই ঋণের বিপরীতে যেমন শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। প্রভিশন হলো আমানতকারীদের আমানত সুরক্ষা রাখতে যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ হবে তার বিপরীতে নির্ধারিত হারে ব্যাংকের আয় থেকে অর্থ আলাদা করে রাখা, যা নিরাপত্তা সঞ্চিতি নামে অভিহিত। সাধারণত, মন্দ মানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। আর এ মন্দ মানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে অর্জিত সুদ আয় খাতে না নিয়ে আলাদা হিসাবে সংরক্ষণ করতে হয়। কেবল মন্দ মানের খেলাপি ঋণ আদায় সাপেক্ষে পরবর্তী সময়ে ওই স্থগিত সুদ আয় খাতে নিতে পারবে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, গত দুই বছর ধরে ঋণের কিস্তি আদায় না হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শিথিলতার কারণে সংশ্লিষ্ট গ্রাহককে ঋণখেলাপি করা হয়নি। এ কারণে ঋণ আদায় করেও সংশ্লিষ্ট ঋণ নিয়মিত দেখানো হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকের নতুন করে খেলাপি ঋণ আর বাড়েনি। আর এর ফলে বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণ বা সুদ স্থগিত করে রাখার প্রয়োজন হয়নি। আর এর ওপর ভর করেই করোনার মধ্যে আয় কমে গেলেও বেশির ভাগ ব্যাংকের মুনাফায় উলম্ফন দেখা গেছে। যদিও ব্যাংকগুলোর এ কৃত্রিম আয়ের পুরোটাই যাতে ডিভিডেন্ড আকারে বণ্টন করতে না পারে সে জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিধিনিষেধ দেয়া হয়েছিল। তবে পুরনো যেসব খেলাপি ঋণ ছিল ওই সব ঋণ আদায় না হওয়ায় এর বেশির ভাগই এখন মন্দ মানের খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর শেষে ৬০টি ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে এক লাখ এক হাজার ১৪৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দ মানের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৮৯ শতাংশ। এর মধ্যে ছয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ৪৪ হাজার ১৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে ৪১ হাজার ৭১০ কোটি টাকা মন্দ মানের খেলাপি ঋণ, যা শতকরা হিসাবে প্রায় ৯৫ শতাংশ। আর বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ৫০ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে ৪২ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা মন্দ মানের খেলাপি ঋণ, যা শতকরা হিসাবে প্রায় ৮৫ শতাংশ। আর বিদেশী ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের ৭৬ শতাংশ মন্দ মানের খেলাপি ঋণ। দুই সরকারি মালিকানাধীন বিশেষায়িত ব্যাংকের ৮৮ শতাংশ মন্দ মানের খেলাপি ঋণ রয়েছে।
মন্দ মানের খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর আয়ও কমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বর শেষে ছয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে মন্দ মানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে ১৯ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার সুদ আয় স্থগিত করে রাখা হয়েছে, যা আগের বছরের সেপ্টেম্বরে স্থগিত করে রাখা হয়েছিল ১৭ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা বেশি আয় স্থগিত করে রাখা হয়েছে আলোচ্য সময়ে। অনুরূপভাবে মন্দ মানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে আলোচ্য সময়ে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সুদ আয় স্থগিত করে রেখেছে ১৯ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের এমন সময়ে ছিল ১৬ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা। আর বিদেশী ব্যাংকগুলো ৩৪৯ কোটি টাকা এবং দুই বিশেষায়িত ব্যাংক সুদ আয় স্থগিত করে রেখেছে এক হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, সামনে খেলাপি ঋণের চাপ আরো বেশি থাকবে। তখন বেশি হারে সুদ আয় স্থগিত করে রাখতে হবে। এতে ব্যাংকের আয়ও কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: