এমডি ছাড়াই চলছে ডিএসই-সিএসই, দাপট নেই শেয়ারহোল্ডার পরিচালকদের

ডিএসইতে এমডির পদ শূন্য হয়েছে এক মাস, সিএসইতে এক বছর ধরে এমডি নেই, # একসময় ডিএসই’র বোর্ডে শেয়ারহোল্ডার পরিচালকদের দাপট থাকলেও এখন স্বতন্ত্র পরিচালকরাই বোর্ডে প্রভাব বিস্তার করছেন, সবশেষ ডিএসই’র তিন এমডির মধ্যে দুজন মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন

এমডি ছাড়াই চলছে ডিএসই-সিএসই, দাপট নেই শেয়ারহোল্ডার পরিচালকদের
প্রথম নিউজ, ঢাকা: প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদ ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছাড়াই চলছে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। অন্য শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই) একই দশা। নিয়মিত এমডি না থাকায় ভারপ্রাপ্ত এমডি দিয়ে চলছে দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জ। ডিএসইতে এমডির পদ শূন্য হয়েছে এক মাস হলো। আর সিএসইতে এক বছর ধরে এমডি নেই।
একদিকে স্টক এক্সচেঞ্জের এমডির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ শূন্য পড়ে রয়েছে, অন্যদিকে যারা স্টক এক্সচেঞ্জের মালিক সেই শেয়ারহোল্ডাররাও ক্ষমতা হারিয়েছেন। এক সময় ডিএসই’র বোর্ডে শেয়ারহোল্ডার পরিচালকরা দাপট দেখালেও এখন সেই চিত্র পাল্টে গেছে। বছর দুয়েক ধরে স্বতন্ত্র পরিচালকরাই বোর্ডে প্রভাব বিস্তার করছেন। ২০১৪ সালে ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন (ব্যবস্থাপনাকে মালিকানা থেকে পৃথককরণ) কার্যকর হওয়ার পর থেকে ডিএসইতে নিয়োগ পাওয়া তিন এমডির মধ্যে দুজন মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। একই অবস্থা সিএসইতেও। এ প্রতিষ্ঠানটিতেও নিয়োগ পাওয়া তিন এমডির মধ্যে দুজন মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি।
সবশেষ ডিএসই’র এমডি হিসেবে তিন বছরের জন্য নিয়োগ পেলেও এক বছরের মাথায় সম্প্রতি পদত্যাগ করেন তারিক আমিন ভূঁইয়া। পদত্যাগের কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমি তিন বছরের জন্য ডিএসই’র এমডি হিসেবে নিয়োগ পেয়ে গত ১৩ মাস অতিক্রম করেছি। এ সময়ে আমি ডিএসইতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারিনি, যা করেছি তাতেও নানা আপত্তির মুখে পড়েছি। তাই আমি পদত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছি।’
অবশ্য তারেক আমিন ভূঁইয়ার আগের এমডিও ডিএসইতে তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। তারেক আমিনের আগে ডিএসই’র এমডি ছিলেন কাজী ছানাউল হক। ২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি তিন বছরের জন্য ডিএসই’র এমডি পদে যোগদান করেন কাজী ছানাউল হক। তবে আট মাস না যেতেই ওই বছরের ৮ অক্টোবর ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তিনি পতদ্যাগ করেন।
ডিএসই’র মতো সিএসইতেও এমডিরা তাদের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। সবশেষ সিএসই’র এমডি হন সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা মামুন-উর-রশিদ। তিনি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিএসই’র এমডি পদে যোগ দেন। তবে দেড় বছর না যেতেই ২০২১ সালের অক্টোবরে তাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়ে চাকরিচ্যুত করা হয়। তার আগে সিএসইতে প্রথম এমডি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ওয়ালি-উল-মারুফ মতিন পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তিন বছরের জন্য সিএসই’র এমডি পদে নিয়োগ পাওয়া ওয়ালি-উল-মারুফ মতিন এক বছর না যেতেই পদত্যাগ করেন।
নিয়মিত এমডি না থাকলে কী ধরনের সমস্যা হয় জানতে চাইলে ডিএসই’র দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ভারপ্রাপ্ত এমডি পলিসিগত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তিনি শুধু রুটিন কাজ করবেন। সুতরাং নিয়মিত এমডি না থাকলে পলিসিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হয়। এছাড়া নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়। 
এদিকে, তারিক আমিন ভূঁইয়া পদত্যাগ করার পর সম্প্রতি ডিএসই নতুন এমডি খুঁজতে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। তিন বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে আগ্রহীদের ৬ নভেম্বরের মধ্যে ডিএসই’র মানবসম্পদ বিভাগীয় প্রধান বরাবর আবেদন পাঠাতে বলা হয়েছে।
ডিএসই’র এমডি পদের জন্য যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা হিসেবে তিনটি শর্ত রয়েছে। শর্তগুলোর যেকোনো একটি অবশ্যই প্রার্থীকে পরিপালন করতে হবে। প্রথম শর্ত হলো ব্যবসা, অর্থনীতি, পরিসংখ্যান, গণিত বা আইনে ব্যাচেলর ডিগ্রিসহ ১০ বছরের ম্যানেজমেন্টের অভিজ্ঞতা। দ্বিতীয়টি হলো, সিএফএ, সিএ, সিএমএ, সিএস, সিপিএ ইত্যাদি পেশাজীবী সনদসহ ১০ বছরের অভিজ্ঞতা। তৃতীয় শর্ত, শেয়ারবাজার নিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যতিক্রম প্রার্থীর ক্ষেত্রে অন্যান্য যোগ্যতা কিছুটা শিথিলযোগ্য হবে।
যোগাযোগ করা হলে ডিএসই’র চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান বলেন, আমরা নতুন এমডির জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। চেষ্টা করছি যত দ্রুত সম্ভব নতুন এমডি নিয়োগ দেওয়ার। তবে কতদিনের মধ্যে নতুন এমডি নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হবে এটা এখনই বলা যাচ্ছে না। এমডি না থাকায় কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এমডি না থাকলে কিছু সমস্যা হয়। এমডি থাকা অবস্থায়ও তো সমস্যা হয়। তবে আমরা চেষ্টা করছি, যত দ্রুত সম্ভব নতুন এমডি নিয়োগ দেওয়া হবে।
এদিকে ডিএসই’র সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডিএসই’র শেয়ারহোল্ডার পরিচালকরা তারিক আমিন ভূঁইয়াকে এমডি হিসেবে রেখে দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু স্বতন্ত্র পরিচালকদের একটি অংশের বিরোধিতার কারণে তাকে ডিএসই ছাড়তে হয়েছে।
এ বিষয়ে ডিএসই’র একাধিক কর্মকর্তা বলেন, রকিবুর রহমান এবং মিনহাজ মান্নান ইমন যখন ডিএসই’র পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন তখন তারা কোনো ধরনের অনিয়ম দেখলে প্রতিবাদ করতেন। একই সঙ্গে পর্ষদের যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন। অনেক সময় রকিবুর রহমান বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলতেন। তার মতের বিপক্ষে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হতো না। কিন্তু রকিবুর রহমান এবং মিনহাজ মান্নান ইমন ডিএসই’র পরিচালনা পর্ষদ থেকে চলে যাওয়ার পর শেয়ারহোল্ডার পরিচালকরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আগের মতো ভূমিকা রাখতে পারেন না। এখন স্বতন্ত্র পরিচালকদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হয়ে আসে।
ডিএসই’র এক সদস্য বলেন, স্টক এক্সচেঞ্জের মালিক শেয়ারহোল্ডাররা। শেয়ারহোল্ডারদের প্রতিনিধি হিসেবে পাঁচজন পরিচালনা পর্ষদে থাকেন। তাদের উচিত শেয়ারহোল্ডারদের ভালো-মন্দ দেখা। স্টক এক্সচেঞ্জ ভালো করলে শেয়ারহোল্ডাররা লাভবান হবেন। একইভাবে খারাপ করলে শেয়ারহোল্ডারদের ক্ষতি। কিন্তু ভালো বা খারাপ যাই হোক স্বতন্ত্র পরিচালকদের ওপর তার কোনো প্রভাব পড়ে না। স্বাভাবিকভাবেই স্বতন্ত্র পরিচালকদের থেকে স্টক এক্সচেঞ্জের প্রতি শেয়ারহোল্ডারদের দরদ বেশি থাকবে। এখন যদি শেয়ারহোল্ডার পরিচালকরা সঠিকভাবে তাদের ভূমিকা পালন করতে না পারেন, সেটা ভালো লক্ষণ নয়। তিনি আরও বলেন, এখন প্রায় শোনা যায় কোনো কোনো স্বতন্ত্র পরিচালক নাকি শেয়ার ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। যদি এমনটা হয়, সেটাও তো ভালো লক্ষণ নয়। এমনটা হলে তারা তো স্টক এক্সচেঞ্জের উন্নয়নের বদলে তাদের ব্যবসা ভালো করার চেষ্টা করবেন। তাই যদি কোনো স্বতন্ত্র পরিচালক শেয়ার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকেন তাহলে তাকে পর্ষদে না রাখাই উচিত।
সম্প্রতি ডিএসই’র ৯৫ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেন তারিক আমিন ভূঁইয়া। এক্ষেত্রে অভিযোগ ওঠে নিয়ম না মেনেই জিএম পদে পদোন্নতি দিয়েছেন ডিএসই’র এমডি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয় এনআরসি’র (নমিনেশন অ্যান্ড রিমিউনারেশন কমিটি) সুপারিশ ছাড়াই এই পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। যদিও চেয়ারম্যানের কাছ থেকে পাওয়া এক বার্তার পরিপ্রেক্ষিতে জিএম পর্যায়ের পদোন্নতি স্থগিত করেন তারিক আমিন ভূঁইয়া। এরপরও একাধিক স্বতন্ত্র পরিচালক ডিএসই’র এমডির বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নেন। তার ভূমিকার কারণে ২২ আগস্ট অনুষ্ঠিত ডিএসই’র পরিচালনা পর্ষদ সভায় এমডি তারেক আমিন ভূঁইয়াকে তোপের মুখে পড়তে হয়। এমনকি পর্ষদ সভার একটা পর্যায়ে তাকে সভা থেকে বের হয়ে যেতে বলা হয়। ফলে এমডির অনুপস্থিতিতে পর্ষদ সভার ওই অংশ অনুষ্ঠিত হয়।
এমন পরিস্থিতিতে পরদিন ২৩ মে ইমেইলে চেয়ারম্যান বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দেন ডিএসই’র এমডি। পদত্যাগপত্রে তিনি অক্টোবরের শেষে অর্থাৎ দুই মাস পরে ডিএসই’র এমডি পদ থেকে পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এমডি পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার দুদিন পরই অর্থাৎ ২৫ মে তড়িঘড়ি করে পর্ষদ সভার আয়োজন করে ডিএসই। ওই সভায় এমডির পদত্যাগ কার্যকরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তারিক আমিন ভূঁইয়া দুই মাস পরে পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করলেও তাকে মাত্র দুই সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom