এক জেলায় ৪ শিক্ষার্থীসহ ৭ জনের আত্মহত্যা ১৫ দিনে !

ফেনী জেলায় উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে আত্মহত্যা। পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে বিরাজ করছ চরম অস্থিরতা।

এক জেলায় ৪ শিক্ষার্থীসহ ৭ জনের আত্মহত্যা ১৫ দিনে !
এক জেলায় ৪ শিক্ষার্থীসহ ৭ জনের আত্মহত্যা ১৫ দিনে !

প্রথম নিউজ, ফেনী: ফেনী জেলায় উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে আত্মহত্যা। পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে বিরাজ করছ চরম অস্থিরতা। গভীর উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় থাকতে হচ্ছে অভিভাবক ও প্রশাসনের লোকদের। গত ১৫ দিনে জেলায় ৭ জন আত্মহত্যা করেছেন। এদের মধ্যে ৪ জন রয়েছে শিক্ষার্থী। এ যেন এক মারাত্মক সামাজিক অবক্ষয়। যার ক্ষত শুকাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের। নিম্ন থেকে উচ্চবিত্ত পরিবারের যেন কেউ বাদ যাচ্ছে না। কথায় কথায় আত্মহত্যার পথকে যেন নিরাপদ মনে করছে ওরা। পরিবারের একজন সদস্য আত্মহত্যার পর তার পরিবারের সদস্যদের পরবর্তী অবস্থা কেমন হচ্ছে তারাতো সেটি আর দেখছে না। ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে ওদের সামাজিক ও পারিবারিক মর্যাদা। গত ১৫ দিনে ৭ জনের আত্মহত্যা করেছে। এদের মধ্যে ৪ জন রয়েছে শিক্ষার্থী। গত ৬ মাসে পুরো জেলায় ৪৪ জন আত্মহত্যা করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। ‘আত্মহত্যাকে না বলুন’ প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে শনিবার (৪ জুন) দাগনভূঞা সরকারি ইকবাল মেমোরিয়াল কলেজে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দাগনভূঞা ইয়ুথ সোসাইটির আয়োজনে কাউন্সিলিং সভা অনুষ্ঠিত হয়। আত্মহত্যার প্রবণতা ও প্রতিকার নিয়ে গত ২৮ মে ফেনী শহরে পুলিশ প্রশাসনের আয়োজনে জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, অভিনেতা, অভিনেত্রী, ক্রিকেটার, সংসদ সদস্য বৃন্দ ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষদের নিয়ে সচেতনতা সভাও করা হয়েছে। এ ছাড়াও গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আত্মহত্যার কুফল সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়েছে। কিছুতেই যেন রোধ করা যাচ্ছে না আত্মহত্যা নামক এ সামাজিক ব্যাধি।

দাগনভূঞা উপজেলার মাতুভূঞা ইউনিয়নের উত্তর আলীপুর গ্রামের নাসরিন আক্তার নিপা (২১) নামে এক গৃহবধূ ৫ জুন রোববার পারিবারিক কলহের জের ধরে আত্মহত্যা করে। এর আগের দিন শনিবার সোনাগাজীতে এক শিক্ষার্থী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। উপজেলার চরদরবেশ ইউনিয়নের চর সাহভিখারি গ্রামের কলিমউদ্দিন হাজীবাড়ির প্রবাসী কামাল উদ্দিনের স্কুল শিক্ষার্থী  আবদুল কাইয়ুম (১৫) শুক্রবার গভীর রাতে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তার কাতার প্রবাসী পিতার কাছে টাকা পয়সা নিয়ে মনোমালিন্যে জিদের বসে আত্মহত্যার পথ বেঁচে নেয়। সে চট্টগ্রামের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র।

১ জুন রাতে দাগনভূঞা পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডে মোস্তাক আহমেদ স্বপনের বড় ছেলে উপম (১৮) আত্মহত্যা করে। একইদিন বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আত্মহত্যা করেন একই উপজেলার পূর্ব চন্দ্রপুর ইউনিয়নের আমু ভূঞার হাট হাছানিয়া দাখিল মাদ্রাসার অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ফারজানা আক্তার (১৪)। সে পাশের রাজাপুর ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামের বেলাল হোসেনের মেয়ে। মাদ্রাসা সুপারের ওপর অভিমান করে সে আত্মহত্যা করেছে বলে জানা যায়। এ ঘটনায় মাদ্রাসার সুপারসহ তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ। ১ জুন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ফুলগাজী উপজেলার সদর ইউনিয়নের নিলখী গ্রামের কুয়েত প্রবাসী আবু জাফর ওরফে বাবুর স্ত্রী সোনিয়া আক্তার (২৮) বিষপানে আত্মহত্যা করে। সোনিয়া পরশুরাম উপজেলার কাউতলী গ্রামের মৃত তাজুল ইসলামের মেয়ে।

ফেনী জেলা ও দায়রা জজ বেগম জেবুন্নেসা বলেন, দেশের আইনে ১৮ বছরের নিচে সবাই শিশু। শুধু শিশুই নয়, দণ্ডবিধির ৩০৫ ধারায় কাউকে আত্মহত্যার প্ররোচনা দিলে সেটি যদি আদালত থেকে প্রমাণিত হয়, তাহলে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারীদের বিরুদ্ধে যদি আইন বিভাগ থেকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে সমাজে ইতিবাচক সাড়া পড়বে। সোনাগাজী পৌরসভার মেয়র অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, আত্মহত্যা রোধে জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতা, মসজিদের ইমাম, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দকে জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে। কুফল সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার প্রচারণার পাশাপাশি পারিবারিকভাবে সবাইকে সচেতন করে তুলতে হবে।

ফেনীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বদরুল আলম মোল্লা জানান, ডিসেম্বর থেকে আজ পর্যন্ত জেলায় আত্মহত্যা করেছে ৪৪ জন। আত্মহত্যার কারণ খুঁজতে গিয়ে আমরা জেনেছি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পারিবারিক কলহ, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের জেরে হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে প্রেমে ব্যর্থতা, অভিমান ও ক্ষোভের কারণেও হয়েছে। আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় জেলা পুলিশ আত্মহত্যা রুখতে সচেতনতামূলক সভার আয়োজন করেছে। ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক অ্যাডভোকেট শাহজাহান সাজু জানান, যত বেশি সচেতনতার প্রোগ্রাম আয়োজন করা যাবে ততবেশি আত্মহত্যার হার কমবে। এসব আয়োজনে অভিভাবক, সন্তান ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষদের সম্পৃক্ত করতে হবে।

দাগনভূঞা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসান ইমাম জানান, দুই শিক্ষার্থীসহ সম্প্রতি উপজেলায় কয়েক শিক্ষার্থী ও প্রবাসীর স্ত্রী আত্মহত্যা করেছে। অথচ এসব শিক্ষার্থীর ভালোমন্দ বোঝার বয়সও হয়ে ওঠেনি। বিভিন্ন কারণে তারা আত্মহত্যা করছেন। সোনাগাজী মডেল থানার ওসি মুহাম্মদ খালেদ দাইয়্যান বলেন, ফেনী জেলায় আত্মহত্যা বৃদ্ধি হওয়া চরম উদ্বেগের বিষয়। ফেনী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার মো. ইকবাল হোসেন ভূঞা বলেন, সম্প্রতি হাসপাতালে নিয়মিত আত্মহত্যার লাশ আসছে। যাদের বেশির ভাগই ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।

ফেনী প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, সরকারি-বেসরকারি ও সামাজিক সংগঠনগুলো সচেতনতামূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি করলে আত্মহত্যার প্রবণতা কমে যাবে। শিক্ষার্থীদের মোবাইল-ইন্টারনেট ব্যবহারের সুফল কুফল সম্পর্কে ধারণা বৃদ্ধি করতে হবে। তিনি বলেন, ফেনী জেলায় আত্মহত্যা নামক একটি সামাজিক ব্যাধি ফেনীবাসীকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ফেনী জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফায়েজুল হক মিল্কি বলেন, সামাজিকভাবে ও পারিবারিকভাবে এর কুফল সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে।

সোনাগাজী ক্লিনিকের মালিক ডা. নুর উল্যাহ বলেন, মানসিক যন্ত্রণা থেকে অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। মানসিক কষ্টের লোকদের যথাযথ কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে এ পথ থেকে বের করে আনতে হবে।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom