ঋণের দায়ে পালানোর উপক্রম পাবনার পেঁয়াজ চাষিদের
রোপণ মৌসুমে অতিবৃষ্টির ফলে পচে যায় প্রথম দফায় লাগানো পেঁয়াজ। এতে দ্বিতীয় দফায় পেঁয়াজ লাগানো ও পরিচর্যায় বড় অংকের ঋণ নিতে হয় তাকে।
প্রথম নিউজ, পাবনা : পাবনা সদর উপজেলার চরতারাপুর ইউনিয়নের কোলচরী গ্রামের বাসিন্দা জিল্লুর রহমান। তিনি সাত বিঘা জমিতে চলতি মৌসুমে মুড়িকাটা পেঁয়াজের আবাদ করেছেন। হালের গরু-ছাগল, অন্যান্য ফসল ও কিছু জিনিসপত্র বিক্রির পুরো টাকাই লগ্নি করেছেন পেঁয়াজ আবাদে। কিন্তু রোপণ মৌসুমে অতিবৃষ্টির ফলে পচে যায় প্রথম দফায় লাগানো পেঁয়াজ। এতে দ্বিতীয় দফায় পেঁয়াজ লাগানো ও পরিচর্যায় বড় অংকের ঋণ নিতে হয় তাকে। সবমিলিয়ে তার ঋণ পাঁচ লাখ টাকার মতো।
শর্ত ছিল পেঁয়াজ উঠলে ফেরত দেবেন ঋণের টাকা। এজন্য মাঝে মধ্যেই সুরুজদের বাড়িতে আসছেন ঋণদাতারা। কিন্তু চলতি মৌসুমে পেঁয়াজের যে ফলন ও দাম চলছে, তা দিয়ে এই ঋণ পরিশোধ সম্ভব নয়। তাই তো খানিকটা ফেরারি হয়ে চলার উপক্রম হয়েছে তাদের। খুব শিগগির পেঁয়াজের দাম না বাড়লে বাবা জিল্লুরকে ফেরারিই হতে হবে বলে আশঙ্কা করছেন ছেলে সুরুজ হোসেন।
সুরুজ হোসেন বলেন, ‘শুরুতে ৫-৬ হাজার টাকা মণ দরে বীজ কিনে মুড়িকাটা পেঁয়াজ রোপণ করেছিলাম। এরপর বৃষ্টিতে নষ্ট হওয়ার পর দ্বিতীয় দফায় ৭-৯ হাজার টাকায় বীজ কিনতে হয়েছে। একটু কম দাম পেতে অন্য জেলা থেকেও এনেছিলাম বীজ। এসব মিলিয়ে পুরো আবাদ বাবদ বিঘাপ্রতি খরচ হয়েছে দেড় লাখ টাকার ওপরে। সেখানে যা ফলন হয়েছে তাতে ৭০-৮০ হাজার টাকার বেশি ওঠার উপায় নেই। এখন যে অবস্থা আমাদের পালাতে হবে। এই ঋণ পরিশোধের কোনো উপায় নেই।’
এই দুর্দশা শুধু সুরুজদের নয়, জেলার সব চাষির। চাষিদের দাবি, মণপ্রতি দুই হাজার টাকার ওপরে খরচ হলেও বর্তমান বাজার ১০০০-১৩০০ টাকা। বিগত মৌসুমের মতো বিঘাপ্রতি ফলন ৬০-৭০ মণ প্রত্যাশা করলেও গড় ফলন হয়েছে ৩৫-৪০ মণ। সবমিলিয়ে ফলন ও কম দামে ব্যাপক লোকসানে পড়েছেন চাষিরা। এ অস্বাভাবিক দরপতনের জন্য ভরা মৌসুমে ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন চাষিরা। দ্রুত আমদানি বন্ধ করে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন তারা।
চরতারাপুরের সানোয়ার হোসেন বলেন, ‘বীজের দাম বেশি থাকায় আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ধারদেনা করে দুই বিঘা জমিতে পেঁয়াজ লাগিয়েছিলাম। এতে মোট ৬০-৭০ মণ ফলন হয়েছে। ১২০০ টাকা করে ২-৩ মণ পেঁয়াজ বিক্রি করেছি। এত কম দামে লোকসান হয়েছে। তাই ভয়ে জমি থেকে পেঁয়াজ তোলা আপাতত বন্ধ রেখেছি।’ গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মুড়িকাটা পেঁয়াজের জমি করেছেন চাষি আমিরুল ইসলাম। তিন বিঘায় যে ফলন হয়েছে তাতে ঋণ পরিশোধ নিয়ে ব্যাপক বিপাকে পড়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গরু-বাছুর সব শেষ। সব বিক্রি করেছি, এরপর লোনও নিয়েছি। আমদানির কারণে পেঁয়াজের দাম একদম নেই। একেবারে শেষ হয়ে গেলাম। এভাবে নিঃস্ব হলে পেঁয়াজ চাষে ধীরে ধীরে সবাই আগ্রহ হারাবেন।’
চরতারাপুর বাহিরচর গ্রামের পেঁয়াজ চাষি মো. রাব্বি বলেন, ‘এ বছর পেঁয়াজের কন্দ অস্বাভাবিক দামে কিনতে হয়েছে। মণপ্রতি ৮-৯ হাজার টাকা। অতিবৃষ্টির কারণে আবার ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। ফলে নতুন করে রোপণ করতে খরচ দ্বিগুণ বেড়েছে। পাশাপাশি সার, কীটনাশকসহ সব উপকরণের দাম বাড়ায় আমাদের বিঘাপ্রতি খরচ প্রায় দুই লাখ টাকায় ঠেকেছে। অথচ এখন বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির কারণে আমরা পেঁয়াজের দাম পাচ্ছি না।’
কয়েকজন আড়তদারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত সপ্তাহে প্রতিমণ মুড়িকাটা পেঁয়াজ ২২০০-২৫০০ টাকায় বিক্রি হলেও বুধবার (২৬ ডিসেম্বর) থেকে তা কমে ১০০০-১৩০০ টাকায় নেমেছে। তবে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার এ বাজার কিছুটা বেড়ে ১৫০০-১৭০০ টাকায় ঠেকেছে। এতে কৃষকরা হতাশ হয়ে পড়ছেন। কমপক্ষে প্রতিমণ তিন হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারলে চাষিরা লাভের মুখ দেখবেন।’
এ বিষয়ে পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. জামাল উদ্দিন বলেন, পেঁয়াজের দরপতনে চাষিরা মারাত্মকভাবে লোকসানে পড়বেন। কৃষি মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসকের পরামর্শে আমরা বাজারে বাজারে ঘুরে ব্যবসায়ীদের কারসাজি না করতে অনুরোধ জানাচ্ছি। জমি থেকে দ্রুত সব পেঁয়াজ না তোলার পাশাপাশি চাষিদের বাজারে অল্প অল্প করে পেঁয়াজ আনার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তিনি আরও জানান, আমদানি বন্ধের বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে লিখিত প্রস্তাবনা পাঠানো হচ্ছে। আশা করছি এ সংকট কাটিয়ে চাষিরা লাভবান হবেন।