ঋণ পরিশোধের চাপ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে

এই ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ৪ বছরের ব্যবধানে বৃদ্ধি পাবে ৭৩ শতাংশ।

ঋণ পরিশোধের চাপ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে

প্রথম নিউজ, অনলাইন: আন্তর্জাতিক বাজারে সুদহার বাড়তে থাকায় বাংলাদেশের ওপর ঋণ পরিশোধের চাপ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে। এর মধ্যে গত কয়েক বছরে চীন, রাশিয়া ও ভারতের কাছ থেকে নেয়া কঠিন শর্তের ঋণ দেশের জন্য দুশ্চিন্তাও বাড়িয়ে দিয়েছে। এই ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ৪ বছরের ব্যবধানে বৃদ্ধি পাবে ৭৩ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয়েছিল ১৫০ কোটি ডলার। চার বছর পর ঋণ পরিশোধে লাগবে ২৬০ কোটি ডলার। অর্থ বিভাগের প্রকাশিত এক তথ্যে শুধু ঋণ পরিশোধের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এর সঙ্গে সুদ যোগ করা হলে পরিশোধের অঙ্ক দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

এদিকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) এক হিসাব অনুসারে, আগামী অর্থবছর বাহ্যিক উৎস থেকে সরকারের অর্থপ্রাপ্তি ১.৫ বিলিয়ন ডলার কমবে এবং পরের অর্থবছরে তা কমবে ২ বিলিয়ন ডলার। এতে চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্বিমুখী এই চাপে সরকারের ব্যয় সক্ষমতা সংকুচিত হবে, ফলে প্রয়োজন অনুসারে তহবিল বরাদ্দও উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যাহত হবে।

ইআরডি’র প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে প্রক্ষেপণ রয়েছে। দুই বছর আগেও যার পরিমাণ ছিল মাত্র ৪৯৬ মিলিয়ন ডলার। ঋণের মূল বা আসলের পরিমাণ হিসাব করলে, চলতি অর্থবছর বৈদেশিক ঋণদাতাদের মোট ৩.৫৭ বিলিয়ন ডলার বা ৩৭ হাজার ১২৮ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে। ইআরডি’র হিসাবে, আগামী দুই অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ইআরডি’র কর্মকর্তারা বলেন, মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সোফর রেট (সিকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সিং রেট) বেড়ে যাওয়ার কারণে বাজারভিত্তিক বৈদেশিক ঋণের সুদ হার বেড়েছে। বর্তমান সোফর রেট ৫.০৫ শতাংশ, এর সঙ্গে স্প্রেড যোগ করে বিদেশি ঋণের জন্য বাংলাদেশকে ৬ থেকে ৭ শতাংশ সুদ দিতে হয়। এর প্রভাবে সুদ পরিশোধে চাপ বেড়েছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে সুদহার বেড়েছে। এটা কমার কোনো লক্ষণ নেই। কাজেই আমাদের ঋণ পরিশোধের হার বাড়বে, এটা খুবই স্বাভাবিক। তিনি বলেন, বাজারভিত্তিক ঋণ ছাড়াও ফিক্সড রেটের (নির্দিষ্ট সুদ হার) ঋণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। অর্থাৎ ঋণ আরও ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে। তাই ঋণ নিতে হবে ভালো প্রকল্পে, যেখান থেকে রিটার্ন আসবে।

ইআরডি’র প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, চলতি অর্থবছেরে বাংলাদেশ সরকারে উন্নয়ন প্রকল্পের ঋণ এবং বাজেট সহায়তার ঋণের জন্য ১.১৯ বিলিয়ন ডলার সুদ পরিশোধ করতে হবে। এরপর ২০২৪-২৫ এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সুদ পরিশোধ করতে যথাক্রমে ১.৩১ এবং ১.৪১ বিলিয়ন ডলার। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশকে ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৪৯৬ মিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১৬ জুন পর্যন্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে, বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধের হিসাব ছিল ৯৪৪ মিলিয়ন ডলার। শুধু সুদ পরিশোধই নয়, আগামী দুই বছরের মধ্যে আসল পরিশোধ বছরে ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা ইআরডি’র।

২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণের আসল বাবদ পরিশোধ করেছে ১.৪১৮ বিলিয়ন ডলার। সদ্য সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১৬ই জুন পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, এর পরিমাণ ছিল ১.৮৪৬ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছর যা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ২.৩৭ বিলিয়ন ডলারে। বেশকিছু বড় প্রকল্পে গ্রেস পিরিয়ড সুবিধা শেষ হওয়ার প্রভাবে পরের দুই অর্থবছর আসল পরিশোধ করতে হবে যথাক্রমে ২.৯০ এবং ৩.৩১ বিলিয়ন ডলার।  ইআরডি’র তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে সুদ-আসল মিলিয়ে মোট পরিশোধের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩.৫৬৫ বিলিয়ন ডলার। তবে এর পরের অর্থবছর থেকে সুদ ও আসল পরিশোধ ৪ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সুদ-আসল মিলিয়ে বাংলাদেশকে উন্নয়ন সহযোগীদের দিতে হবে ৪.৭২ বিলিয়ন ডলার। তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ আসল ও সুদ মিলিয়ে পরিশোধ করে ১.৯১৪ বিলিয়ন ডলার। এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে এর পরিমাণ ছিল ২.৭৯০ বিলিয়ন ডলার।

ইআরডি’র কর্মকর্তারা জানান, কোভিড পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি)’র কাছ থেকে সোফর রেটে বাজেট সহায়তা নেয়ার কারণে সুদ পরিশোধের চাপ আরও বেড়েছে।

বাজেট সহায়তা সুদ পরিশোধের পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণের আসল পরিশোধেও চাপ বাড়িয়েছে। এছাড়া, চলতি অর্থবছরে বেশকিছু বড় প্রকল্পের জন্য নেয়া ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হচ্ছে। ফলে এসব প্রকল্পে আসল পরিশোধ করতে হবে বলে জানান তারা। ইআরডি’র তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২১ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো বৈদেশিক ঋণ ছাড় হয় ১০ বিলিয়ন ডলার। এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করছে ইআরডি। ইআরডি’র প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড় ১১.৭৮৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে। এর পরের দুই অর্থবছরে ছাড় কমলেও তা ১০ বিলিয়ন ডলারের উপরে থাকবে।

এদিকে গত এক দশকে ৩ দেশ থেকে সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৬২৮ কোটি ডলার ঋণ নেয়ার চুক্তি হয়েছে। বর্তমান বাজারদরে টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে চীনের ১২ প্রকল্পে ১ হাজার ৭৫৪ কোটি ডলার, রাশিয়ার রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলার এবং ভারত তিনটি লাইন অব ক্রেডিটে (এলওসি) ৭৩৬ কোটি ডলার দিচ্ছে। বিশ্বব্যাংক, এডিবি’র ঋণ পরিশোধের জন্য মোটা দাগে সময় পাওয়া যায় ৩২ থেকে ৩৫ বছর। কিন্তু গ্রেস পিরিয়ডের পর চীন ও ভারতের ঋণ পরিশোধ করতে হবে ১৫ থেকে ২০ বছরে।

পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলমান বৈদেশিক মুদ্রার সংকট সামাল দিতে পাইপলাইনে থাকা বিদেশি ঋণের অর্থ ব্যবহারের দিকে নজর দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।