আমি তো বাবা, কীভাবে সন্তানের লাশ কাঁধে নিবো
কোটা বিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষের ঘটনায় শুক্রবার পুলিশের গুলিতে আহত হন।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: বিশ বছর বয়সী ইমতিয়াজ আহমেদ জাবির। সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির বিবিএ’র শিক্ষার্থী ছিলেন। বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণে যশোর থেকে এসেছিলেন ঢাকায়। কিন্তু সেই স্বপ্ন নিভে গেছে চিরতরে। কোটা বিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষের ঘটনায় শুক্রবার পুলিশের গুলিতে আহত হন। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার ভোররাতে তার মৃত্যু হয়। একমাত্র ছেলের মৃত্যুতে পাগলপ্রায় তার বাবা মো. নওশের। স্ট্রেচারে মর্গের সামনে রাখা সন্তানের নিথর দেহটির দিকে তাকিয়ে অঝরে কাঁদছিলেন তিনি। সন্তানের লাশের বোঝা কাঁধে নিয়ে কীভাবে ফিরবেন তিনি। কৃষক বাবার কষ্ট লাঘবে হাল ধরতে চেয়েছিলেন ইমতিয়াজ। তার স্বপ্ন ছিল বিদেশে পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার।
নওশের বলেন, আমি তো বাবা, কীভাবে সন্তানের লাশ কাঁধে নিবো? আমার ছেলের কোমরের নিচের পাশে দুইটা গুলি লাগে। আমি কৃষিকাজ করলেও আমার স্বপ্ন ছিল ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলবো। ওর স্বপ্ন ছিল আমেরিকায় পড়াশোনা করবে। কিন্তু অল্প বয়সে ছেলেটি চিরতরে চলে গেল। ও খুব মেধাবী ছিল। সারাক্ষণ পড়াশোনা ছাড়া কিছুই বুঝতো না। যশোর আকিজ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে ঢাকায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। আমার স্ত্রী ও একমাত্র মেয়েকে নিয়ে আমরা যশোরে থাকি। আমার ছেলে বনশ্রীতে একটি হোস্টেলে থাকতো। ১৯ তারিখে বাসা থেকে খাবার খেয়ে বের হলে রামপুরা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়। পরে আমার ছেলেকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিলে অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য সোমবার ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। শুক্রবার ভোর ৪টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
ঝিকরগাছার বাসিন্দা নওশের আলীর দুই সন্তানের মধ্যে ইমতিয়াজ ছিল বড়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ও বাবাগো, আমার বাবা কই? ছেলে যখন আইসিইউতে ছিল তখন বলেছিল- ‘বাবা আমি ঠিক আছি তুমি চিন্তা করিও না। তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করবো।’ ওর চিকিৎসায় দেড় লাখের মতো খরচ হয়েছে, দেড় লাখ কেন বিশ লাখ খরচ করতাম আমার সোনাটা বেঁচে থাকলো না। ছেলে কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল না সবসময় পড়াশোনার মধ্যে থাকতো। আমার সন্তান মারা গেছে, মরেও শন্তি নেই পদে পদে হয়রানি। সকাল থেকে ঘুরছি এখান থেকে সেখানে এখন বিকাল হয়ে গেছে। কি হবে আমার, কে দেখবে আমাকে? কতো স্বপ্ন ছিল ছেলেটাকে নিয়ে। ওর একমাত্র বোন-মা পাগল হয়ে গেছে। গত কয়েকদিন ধরে তারা কিছুই খায় না। ওর মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
২০১৮ সালে বাগ আঁচড়া হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করে। জিপিএ-৫ পেয়ে ২০২১ সালে এইচএসসি পাস করেন। পরে জাবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে ২০২১-২২ শিক্ষা বর্ষে ঢাকার সাউথইস্ট ইউনির্ভাসিটিতে বিবিএতে ভর্তি হন।
এদিকে শুক্রবার জুমার নামাজের পর নওশের আলীর গ্রামের বাড়ি ঝিকরগাছার হাজিরবাগ ইউনিয়নের দেউলী গ্রামে গেলে হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখা যায়। জাবিরের মৃত্যুর খবরে গোটা গ্রামবাসীর মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সবাই শোকাহত। কখন আসবে তাদের সকলের প্রিয় জাবিরের লাশ সেই অপেক্ষায় ছিলেন অনেকে। নওশের আলীর বাড়ির উঠোনে হাজিরবাগ ৯নং ওয়ার্ডের সদস্য শেখ হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, এই পরিবারটি খুবই নিরীহ প্রকৃতির। কারও সঙ্গে এদের কোনো ঝগড়াঝাটি বা গণ্ডগোল হয়েছে বলে আমার জানা নেই। নওশের খুবই সাদাসিধে মানুষ। তিনি কৃষিকাজ করে জীবন নির্বাহ করেন। কোনোদিন রাজনীতির সঙ্গে বা কোনো দলাদলির সঙ্গে ছিলেন না।
জাবিরের স্কুল শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম বলেন, জাবির ও তার বোন দুইজনই আমার ছাত্র ছিল। তারা খুবই ভদ্র। তারা দুই ভাইবোনই লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিল। জাবির তো সব সময় ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছিল। সে আমাদের গর্ব ছিল। তাকে নিয়ে আমাদের অনেক আশা ছিল। জাবিরের মৃত্যুর খবরে তার শিক্ষকরাও মর্মাহত।
ওদিকে সহিংসতার ঘটনায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মাইন উদ্দিন (২৪) নামে আরেক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত ২টার দিকে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন এন্ড প্লাস্টিক ইউনিটে তার মৃত্যু হয়। নিহতের বাবা মো. কামরুল ইসলাম বলেন, আমার ছেলে যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকায় একটি টিউশনি শেষ করে বাসায় ফেরার পথে হঠাৎ গুলি লাগে। পরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২টার দিকে ছেলেটি মারা যায়। তিনি বলেন, আমাদের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায়।