আগ্নেয়াস্ত্রে বেড়েছে খুন: অস্ত্রধারীর ‘সেফ জোন’ রাজনৈতিক পরিচয়
পাহাড় কিংবা সমতল, নগর বা মহানগর সব জনপদে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে খুনের ঘটনা বেড়েছে। অস্ত্রধারীরা কখনও ভাড়ায় আবার কখনও নিজের প্রয়োজনে খুন, ছিনতাই, ডাকাতি ও যবরদখলসহ বিভিন্ন অপরাধ করছে।
প্রথম নিউজ, ঢাকা: পাহাড় কিংবা সমতল, নগর বা মহানগর সব জনপদে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে খুনের ঘটনা বেড়েছে। অস্ত্রধারীরা কখনও ভাড়ায় আবার কখনও নিজের প্রয়োজনে খুন, ছিনতাই, ডাকাতি ও যবরদখলসহ বিভিন্ন অপরাধ করছে। কখনও তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হচ্ছে, আবার কখনও এসব হত্যার রহস্য উদঘাটন হয় না। সন্ত্রাসী ও অস্ত্রধারীরা রাজনৈতিক ছত্রছায়া পাওয়ায় তাদের একটি ‘সেফ জোন’ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সাম্প্রতিক রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নাঞ্চলে অবৈধ অস্ত্রের গুলিতে রাজনৈতিককর্মী, ব্যবসায়ী, সাবেক সেনাকর্মকর্তা, আদিবাসী ও সাধারণ মানুষের মৃত্যু হওয়ায় অবৈধ অস্ত্র দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, ‘সন্ত্রাসী একটি গোষ্ঠীর কাছে অসংখ্য আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। কারণ অনেক দিন ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ কোনও কার্যক্রম দেখা যায়নি। তাই গত ইউপি নির্বাচনেও এসব অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে এবং মানুষ খুন হয়েছে।
সন্ত্রাসীদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিচয় থাকায় তারা একটি ‘সেফ জোন’ তৈরি করেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান করে এসব আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার না করলে, সুষ্ঠু নির্বাচনে প্রতিবন্ধকতা হতে পারে বলেও তারা আশঙ্কা করেন।
আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আগ্নেয়াস্ত্রে যত খুনোখুনি: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার নাটঘর ইউনিয়নে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর রাতে এরশাদুল হক ও তার সহযোগী বাদল সরকারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় এরশাদুলের ছোট ভাই বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন। সেই মামলায় আশরাফুল ইসলাম রাব্বি (৩৭) নামের সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেফতার করে স্থানীয় পুলিশ। রাব্বি হত্যার কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করে। অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করে দুজনকে হত্যা করে রাব্বি। তার সঙ্গে আরও সহযোগী ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও প্রশাসন) মোল্লা মোহাম্মদ শাহীন রাব্বিকে গ্রেফতারের পর জানান, ‘হত্যা- পাল্টা হত্যার ঘটনা এটি। সব আসামি শনাক্ত করা হয়েছে। আসামি রাব্বি গ্রেফতারের পর অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে হত্যার বিষয়টি স্বীকার করেছে।’
এ বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় সিদ্দিকুর রহমান (৪০) নামের স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতাকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ সময় আরও তিন জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। নিহত সিদ্দিকুর রহমান উপজেলার চাঁদগ্রাম ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড চাঁদগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। গত ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের সময়কার বিরোধের জের ধরে এ ঘটনা ঘটেছে বলে স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে। এর আগে ২ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জে আকবর হোসেন (৫০) নামের এক যুবদল নেতাকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। আকবর হোসেন (৫০) সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়নের বড় সারুটিয়া গ্রামের মৃত মজিবুর রহমানের ছেলে। তিনি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়ন যুবদলের প্রস্তাবিত কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন বলে জানা গেছে।
ঢাকায় অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রে বেড়েছে খুন: ঢাকার শাহজাহানপুরে গত বৃহস্পতিবার (২৪ মার্চ) রাতে মাইক্রোবাসে থাকা মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যার উদ্দেশে এলোপাতাড়ি গুলি করে পালিয়ে যায় এক দুর্বৃত্ত। এ সময় পাশে রিকশায় থাকা সামিয়া আফনান প্রীতি নামেও এক তরুণী গুলিবিদ্ধ হন। পরে দুজনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাদের মৃত ঘোষণা করেন। এই জোড়া খুনের ঘটনায় ফের অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। হামলাকারী যে অস্ত্রটি ব্যবহার করেছে সেটি অত্যন্ত আধুনিক ও স্বয়ংক্রিয় বলে মনে করছে পুলিশ। হত্যাকারী নিজেও পেশাদার। সে অস্ত্র চালাতে পারদর্শী বলে জানিয়েছে পুলিশ। ২০২০ সালে ঢাকায় ২১৯টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ২০২১ সালে হত্যাকাণ্ড কমে ১৬৬ হলেও এ বছরের জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেড়েছে। প্রথম দু’মাসে ৯টি ও ১২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব হত্যকাণ্ডে বেশিরভাগ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হয়েছে বলে পরিসংখ্যানে দেখা গেছে।
স্থানীয় নির্বাচনেও ছিল আগ্নেয়াস্ত্রের অধিপত্য: বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর তথ্য মতে, গত ইউপি নির্বাচনি সহিংসতায় দেশের ৪৫ জেলায় ১২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে মেম্বার প্রার্থীর সমর্থক ৪৯ জন, আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থক ২৮ জন, বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থক ২০ জন, সাধারণ গ্রামবাসী ১২ জন, আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী ২ জন, মেম্বার প্রার্থী ২ জন, পরাজিত মেম্বার প্রার্থী ২ জন এবং পরিচয় জানা যায়নি ৭ জনের। এসব হত্যাকাণ্ডের বেশিরভাগ পিটিয়ে ও গুলি করে ঘটেছে বলে সংগঠনটি দাবি করেছে।
সন্ত্রাসীরা হত্যাকাণ্ডে কেন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে?: সন্ত্রাসীরা নিজেদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র রেখে তার বিভিন্নভাবে আন্ডারওয়াল্ডে প্রচার করে। এতে তাদের অস্ত্রটি ভাড়ায় ব্যবহার বেড়ে যায়, সন্ত্রাসীদের অবৈধ আয়ও বৃদ্ধি পায়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন উপপুলিশ কমিশনার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একটি অস্ত্র চার থেকে পাঁচ হাত ঘুরে ব্যবহার হয়। অনেক সময় হত্যাকারী নিজেও জানে না, অস্ত্রটি কার। কারণ কয়েকটি হাত ঘুরে তাকে দিয়ে হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয়। তিনি বলেন, ‘মূলত আগ্নেয়াস্ত্রগুলো তারা সহজে বহন করে কিলিং মিশনে অংশ নিতে পারে। মানুষের মনে আতঙ্কা সৃষ্টি করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে পারে। টার্গেটকে নির্দিষ্ট করতে পারে। তাই সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে।’
সন্ত্রাসীরা অস্ত্র পায় কীভাবে?: ২০০১ সালে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ভৌগলিক কারণে বাংলাদেশ মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের রুটে পরিণত হয়েছে। এছাড়া মিয়ানমার ও ভারতের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কারণে বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় অবৈধ অস্ত্র পাচার হয়। গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর দারুসসালাম এলাকা থেকে আন্তর্দেশীয় অস্ত্র কারবারি চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। এই চক্রের অন্যতম সদস্য আকুল হোসেন যশোরের শার্শা উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি। ভাসানটেকে এক ঠিকাদারকে গুলির ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্রের উৎস অনুসন্ধানে নেমে চক্রটির সন্ধান পায় ডিবির গুলশান বিভাগ। আকুল হোসেনকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, ছয় বছরে দুই শতাধিক অস্ত্র বিক্রি করেছে সে। এর সবই আনা হয়েছে সীমান্ত পথে ভারত থেকে।
দেশের সীমান্ত জেলা যশোরের বেনাপোল, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, সাতক্ষীরার শাঁকারা, মেহেরপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুমিল্লা, কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া ও বান্দরবান পাহাড়ী এলাকা থেকে অবৈধ অস্ত্র ঢুকছে বলে একাধিক অস্ত্র মামলার আসামি তাদের স্বীকারোক্তিতে বলেছে।
দেশের সন্ত্রাসীরা কী ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহা করে?: দেশের সন্ত্রাসীরা সাধারণত ছোট পিস্তল ব্যবহার করে। তবে সাধারণ অস্ত্রের পাশাপাশি অত্যাধুনিক অস্ত্রও দেশে ঢুকছে। বিষয়টি আলোচনায় আসে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর। ওই হামলার জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে আমের ঝুড়িতে করে আনা হয় একে-২২। যশোরের চৌগাছা সীমান্ত দিয়ে আনা হয় বোমা। এছাড়াও বন্দুক, রাইফেল, বিদেশী বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পিস্তল উদ্ধার হয়েছে সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে।
অস্ত্র উদ্ধার হলেও তা পর্যাপ্ত নয়: আন্তর্জাতিকভাবে চোরাচালানের একটি গ্রহণযোগ্য হিসাবও সর্বোত্র স্বীকৃত। তা হলো—অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান যা ধরা পড়ে, তা দেশে আসা চোরাচালানের মাত্র ১০ ভাগ। বাকি ৯০ ভাগ ধরা পড়ে না। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ২০২০ সালে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় ১২৪টি মামলা করে। ২০২১ সালে ১১৮টি অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় মামলা করে। তবে এই দুই বছরে রাজধানীতে খুনের ঘটনাই ঘটেছে ২১৯ ও ১৬৬টি।
রাজনৈতিক পরিচয় অস্ত্রধারীদের ‘সেফ জোন: সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাজনীতির সঙ্গে সন্ত্রাসবাদ মিলে গেছে। তাই সন্ত্রাসীরা একটি করিডোর বা সেফ জোন পেয়েছে। রাজনীতিবিদরাও তাদের ব্যবহার করে। আবার সন্ত্রাসীরাও রাজনীতিবিদদের ব্যবহার করে। সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে স্বার্থের রাজনীতি যত বৃদ্ধি পাবে, তত অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীও বাড়তে থাকবে। তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চা হলে এসব অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের কোনও অস্থিত্ব থাকবে না।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:
https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews