আইন ভেঙে ঠিকাদারি চালাচ্ছেন ডিএসসিসি’র কাউন্সিলর

আইনের তোয়াক্কা না করেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৫৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আকাশ কুমার ভৌমিক ঠিকাদারি কাজ নিয়েছেন নিজের নামে ও তার স্ত্রী পপি রানী ভৌমিকের নামে।

আইন ভেঙে ঠিকাদারি চালাচ্ছেন ডিএসসিসি’র কাউন্সিলর
ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৫৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আকাশ কুমার ভৌমিক

প্রথম নিউজ, ঢাকা: স্থানীয় সরকার আইন, ২০০৯ (সিটি করপোরেশন) এর ধারা ৯ (২) অনুযায়ী, কোনও ব্যক্তি মেয়র বা কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হওয়ার অথবা মেয়র বা কাউন্সিলর পদে থাকবার যোগ্য হবেন না— যদি তিনি বা তার পরিবারের কোনও সদস্য সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনের কাজ সম্পাদন বা মালামাল সরবরাহের জন্য ঠিকাদার হন। অথবা তারা এ ধরনের কাজে নিযুক্ত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হন বা সিটি করপোরেশনের কোনও বিষয়ে তাদের কোনও ধরনের আর্থিক স্বার্থ থাকে। অথবা তিনি বা তারা সরকার নিযুক্ত অত্যাবশ্যক কোনও দ্রব্যের ডিলার হন।

কিন্তু এ আইনের তোয়াক্কা না করেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৫৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আকাশ কুমার ভৌমিক ঠিকাদারি কাজ নিয়েছেন নিজের নামে ও তার স্ত্রী পপি রানী ভৌমিকের নামে। দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পুরান ঢাকার ধুপখোলা মাঠে মাল্টিপারপাস ভবন নির্মাণে ১৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকার কাজ করছে মেসার্স তালুকদার অ্যান্ড কোম্পানি। এছাড়া ২০ কোটি ৫০ লাখ টাকার কাজ করছে মেসার্স প্রভাতী অ্যান্ড কোম্পানি।

এসব কাজের মধ্যে রয়েছে পাঁচতলা ভবনের চার তলায় ৩৯৪টি দোকান নির্মাণ, পঞ্চম তলায় একটি খাবার দোকান, অফিস স্পেস ও বেজমেন্টে ৫৮টি গাড়ির পার্কিং। এছাড়া, মেসার্স প্রভাতী অ্যান্ড কোম্পানি দক্ষিণ সিটির ৭ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র নির্মাণের কাজ করছে, নির্মাণ ব্যয় হবে ১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র নির্মাণ কাজের জন্য জমা দেওয়া ট্রেড লাইসেন্স, আয়করের কাগজ ও জাতীয় পরিচয়পত্রে দেখা যায়, মেসার্স প্রভাতী অ্যান্ড কোম্পানির মালিক পপি রানী ভৌমিক। তার স্বামীর নাম আকাশ কুমার ভৌমিক। তাদের বাসার ঠিকানা ১০৮৩ মেরাজনগর, শ্যামপুর, ঢাকা। যা আকাশ কুমারেরও বাসা। পপি রানীকে এ কাজের অফিস আদেশ দেওয়া হয় ২০২০ সালের ২৪ নভেম্বর।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন-২০২০ এর হলফনামায় উল্লিখিত ‘স্বশিক্ষিত’ এই কাউন্সিলর (আকাশ কুমার ভৌমিক) তার ব্যবসা/পেশার বিবরণীর অংশে লিখেছেন— মেসার্স তালুকদার অ্যান্ড কোম্পানি তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান। এছাড়া ধূপখোলা মাঠে মাল্টিপারপাস ভবনের নির্মাণ কাজের চুক্তিনামায় মেসার্স তালুকদার অ্যান্ড কোম্পানির মালিক হিসেবে সই করেছেন আকাশ কুমার ভৌমিক। তার পাশে সিটি করপোরেশনের পক্ষে সই করেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মুন্সি মো. আবুল হাসেম। আর সাক্ষী হিসেবে সই করেন তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী প্রেম ধন রুদ্র পাল ও জিহাদ মাতুব্বর নামে একজন।

এছাড়া আকাশ কুমার ভৌমিক এ কাজের জন্য যে ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বরের সনদপত্র জমা দিয়েছেন, তা ২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তারিখে স্বাক্ষরিত। সেখানে তাকে এ কোম্পানির মালিক হিসেবে দেখানো হয়েছে। কাউন্সিলরের প্রতিষ্ঠানের কাজের চুক্তিনামায় তার নামের পাশে সাক্ষী হিসেবে বৈধতার প্রশ্ন না তুলে কেন সই করলেন প্রশ্নে প্রেম ধন রুদ্র পাল  বলেন, ‘এগুলো আমার দফতরের হেড ক্লার্ক দেখে। হেড ক্লার্ক রেডি করে দিয়েছে, আমি সই করেছি। শুধু আমি কি স্বাক্ষর করেছি? আরও তো অনেকে স্বাক্ষর করেছে। পুরান জিনিস আমার মনে নেই’, বলেই ফোন কেটে দেন তিনি।

এ বিষয়ে জানতে ধূপখোলা মাঠ উন্নয়ন প্রকল্পের তৎকালীন পরিচালক মুন্সি মো. আবুল হাসেমকে কল করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তার সহকর্মীরা জানিয়েছেন তিনি অসুস্থ। মেসার্স প্রভাতী অ্যান্ড কোম্পানি ও মেসার্স তালুকদার অ্যান্ড কোম্পানির ঠিকানা একই— ১৭৭, শহীদ নজরুল ইসলাম সরণী, বিজয় নগর, মাহতাব সেন্টার, ঢাকা।

কাউন্সিলর হিসেবে আইন ভঙ্গ করে কীভাবে নিজ প্রতিষ্ঠানে ঠিকাদারি করছেন, জানতে চাইলে আকাশ কুমার ভৌমিক  বলেন, ‘আপনার জানতে ভুল হয়েছে। এটি এখন আর আমার নেই। আমি দুই বছর আগে ট্রেড লাইসেন্সটি আমার ভাই হেমন্ত কুমার ভৌমিক ও মায়ের (প্রিয় বালা ভৌমিক) নামে দিয়ে দিয়েছি। এখন ট্রেড লাইসেন্সের স্বত্বাধিকারী হলো— আমার মা ও আমার ভাই। আমি আর এসব ব্যবসা-বাণিজ্য করি না।’

কাউন্সিলরের মা-ভাই ঠিকাদারি করতে পারেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনি আইন ভালো করে জেনে নেন। না জেনে ভুলভাল লেইখা... আপনার জন্য আইন আছে, আমার জন্যও আইন আছে। আপনার হাতে কলম আছে,  আবার আমার জন্য কোর্ট খোলা আছে। যারা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক, তারা তাদের মতো ব্যবসা করতে পারবে। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারের লোকজনের ব্যবসা-বাণিজ্য করা যাবে না—কোন আইনে লেখা আছে। সে বইটা একটু আমার কাছে পাঠাইয়া দিয়েন। আর আপনি লিখলে কোর্টে আপনার সঙ্গে দেখা হবে।’

চুক্তিনামায় তার নিজের সইয়ের বিষয়টি জিজ্ঞেস করা হলে, কাউন্সিলর আকাশ কুমার বলেন, ‘এটি জাল করা হয়েছে। আর আমার কাউন্সিলর হওয়ার আগে কোনও সই থেকে থাকতে পারে। আমি ২০ বছর ধরে ঠিকাদারি ব্যবসা করি। উল্লেখ্য, স্থানীয় সরকার আইনে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে নির্বাচনের যোগ্যতা ও অযোগ্যতা অংশে বলা আছে—‘সিটি করপোরেশনের কোনও ঠিকাদার এ পদে নির্বাচন করতে পারবে না। জানা গেছে, ধূপখোলা মাঠের দুটি প্যাকেজের  কার্যাদেশ দেওয়া হয় ২০২১ সালের ১ জুলাই। আর আকাশ কুমার ভৌমিক কাউন্সিলর নির্বাচিত হন ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে।

কাউন্সিলরের নিজের নামে ও স্ত্রীর নামে থাকা প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে কাজ দিলেন জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বলেন, ‘আইনানুযায়ী একজন কাউন্সিলর  ও তার ওপর নির্ভরশীলদের সিটি করপোরেশনে ঠিকাদারি করার সুযোগ নেই। এছাড়া এ বিষয়ে আমাদের বোর্ডেরও সিদ্ধান্ত আছে। বিষয়টি আমাদের প্রকৌশল বিভাগ দেখে। এরকমটি যদি হয়ে থাকে, তাহলে আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবো। এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক মো. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘কোনও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে একই প্রতিষ্ঠানে তিনি ঠিকাদারি কাজ করতে পারেন না। এটা জনপ্রতিনিধিত্ব আইন ও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটা স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতার অপব্যবহার।’

তিনি আরও বলেন, ‘এটি যদি তার পরিবারের অন্য কারও নামেও হয়, একই কথা প্রযোজ্য হবে। এই সিদ্ধান্ত তো তিনি একা নেন না। এর সঙ্গে অন্য যারা জড়িত তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তাকে কাজ দেওয়ার এই অবৈধ প্রক্রিয়ায় জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় দৃষ্টান্তমূলক জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এগুলো না ঘটে।’

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom