অর্থনীতির সংকটে ক্ষমতার রাজনীতি দূরে রাখার পরামর্শ
গতকাল সোমবার সম্পাদক পরিষদ ও সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নিউজ পেপার ওনার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) যৌথভাবে আয়োজিত আলোচনা সভায় দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা এসব কথা বলেন।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: দেশের অর্থনীতির প্রতিটি খাতই এখন সংকটে। রেমিট্যান্সে ইতিবাচক ধারায় নেই, রপ্তানি প্রবৃদ্ধিও আশাব্যঞ্জক নয়। আগে নেতিবাচক দিকগুলো সামাল দেয়া গেলেও এখন কঠিন হয়ে গেছে। অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে ব্যাংক খাত চরম ঝুঁকিতে পড়েছে। বিভিন্ন অনুগত স্বার্থগোষ্ঠীকে ব্যাংক থেকে অন্যায় সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে, যার সঙ্গে ক্ষমতার রাজনীতি সম্পৃক্ত। এতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ে ও বিনিয়োগের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সৎ উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহিত হন। তাই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে হলে আর্থিক খাতসহ কিছু সংবেদনশীল খাতকে ক্ষমতার রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে হবে।
গতকাল সোমবার সম্পাদক পরিষদ ও সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নিউজ পেপার ওনার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) যৌথভাবে আয়োজিত আলোচনা সভায় দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা এসব কথা বলেন। রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে ‘অর্থনীতির চালচিত্র ও প্রস্তাবিত বাজেট ২০২৪-২৫’- শীর্ষক এ আলোচনায় অংশ নেন বিশিষ্টজনেরা।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন- সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ্উদ্দিন আহমেদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিপিআরসি’র নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, সাবেক অর্থসচিব ও সাবেক কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। স্বাগত বক্তব্য দেন- নোয়াবের সভাপতি এ. কে. আজাদ এমপি। সমাপনী বক্তব্য দেন- সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহফুজ আনাম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ।
দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণকারী খাতই এখন অরক্ষিত। এটা বিশৃঙ্খল অবস্থায় রয়েছে। কোটি কোটি টাকা তছরুপ হচ্ছে, আবার টাকা জমাও হয়, রাতারাতি সে টাকা উধাও হয়ে যায়। তিনি বলেন, প্রশাসনের সর্বস্তরে অনিয়ম, দুর্নীতির কারণে সরকারি ব্যয়ে প্রচুর অপচয় হয়েছে। অর্থনীতিতে আস্থার পরিবেশ তৈরি হয়নি। অবাধে কালো টাকার সঞ্চালন ও পুঁজিপাচার হচ্ছে। দেশ একটি নৈতিকতাহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। এবারের বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। তবে স্মার্ট মানুষ যদি নীতিহীন হয় তা আরও ভয়ঙ্কর হতে পারে।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, সময়মতো সঠিক পদক্ষেপের অভাবে মূল্যস্ফীতি আমাদের ওপর গেড়ে বসেছে। ঠিক সময়ে বিশ্বাসযোগ্য নীতি নেয়া হয়নি। দীর্ঘদিন থেকে ভুল নীতির কারণে মৌলিক অনেকগুলো দুর্বলতা সামনে এসেছে। সঠিক নীতির অভাবে অর্থপাচার, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, রিজার্ভের ধারাবাহিক পতন, রাজস্ব আয় হ্রাস, কালো টাকা তৈরি হচ্ছে। মৌলিক নীতিগত পরিবর্তন না আনলে এসব সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, বাজেট ঘাটতি পূরণ করতে আমরা দেশ এবং বিদেশ থেকে উচ্চ সুদে একের পর এক ঋণ নিয়েই চলেছি। ঋণ-নির্ভরতা কমাতে সরকারের কোনো পদক্ষেপ আছে নাকি গা ছাড়া বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে তা বিবেচনা করা দরকার। ঋণের উপর নির্ভর করে এভাবে অর্থনীতি চলতে থাকলে একসময় দেউলিয়া না হলেও বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়বে। এই মুহূর্তে আমাদের অর্থনীতির সবগুলো সূচক খারাপ। যতদিন সূচকগুলো ভালো ছিল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ছিল রেমিট্যান্স ভালো ছিল রিজার্ভের অবস্থাও ভালো ছিল। তখন অর্থনৈতিক ত্রুটি হজম করার শক্তিও ছিল।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, সিংহভাগ দুর্নীতিবাজ উচ্চবিত্ত যখন সরকারের কর ঠিকমতো পরিশোধ করে না, তখন কিছু সৎ করদাতার ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দিলে তারাও আর সৎ থাকে না। সামগ্রিক অর্থনীতি একটা ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। ভঙ্গুর পরিস্থিতির মধ্যেই জাতীয় বাজেট উত্থাপন হয়েছে সংসদে। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। ব্যাংক খাতের অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম আর খেলাপির পাল্লা ভারী হচ্ছে। দুর্নীতি, অর্থপাচার আর বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। তিনি বলেন, আমাদের বাজেটের অবস্থা দেখলে বোঝা যায় রাজস্ব আয়ের সবচেয়ে নিম্ন্নতম হারের দিকে আমরা অবস্থান করছি। এর সঙ্গে রয়েছে আইএমএফ’র চাপ আর নানা ভর্তুকির বোঝা। দেশের শীর্ষ এ অর্থনীতিবিদ বলেন, সরকারি ব্যয়ের অপচয় রোধ করতে পারিনি, বাজেটেও তার প্রতিফলন হয়নি। ব্যাপক অপচয় হচ্ছে, এখানে আস্থা তৈরি হয়নি। এক্ষেত্রে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাকে কাজে লাগাতে পারছি না।
খেলাপি ঋণ মডেলই এখন বিজনেস মডেল: সালেহউদ্দিন আহমেদ
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, খেলাপি ঋণ মডেলই এখন দেশের জন্য একটা বিজনেস মডেল হয়ে গেছে। আপনি ব্যাংক থেকে ঋণ নেবেন, আর ফেরত দেবেন না। এই মডেল চলছে। তিনি বলেন, বলা হচ্ছে সংকোচনমূলক বাজেট, অথচ বাজেটের ঘাটতি তো সংকোচনমূলক মনে হয় না। আবার ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে। সরকার যদি বেশি ঋণ নেয়, তাহলে বেসরকারি খাত কীভাবে ঋণ পাবে। আর ব্যক্তিগত খাত ঋণ না পেলে কর্মসংস্থান হবে কীভাবে। এ অবস্থায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত। সালেহউদ্দিন আরও বলেন, বাজেট করতে হবে পারফরম্যান্স নির্ভর। কিছু সংস্থা দরকার হলে বন্ধ করে দিতে হবে, কিছু সংস্থার জনবল কমাতে হবে। কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে। সূর্যের আলোর মতো স্বচ্ছ হতে হবে। তখন বাজেট যে আকারই হোক, সমস্যা হবে না।
পরিশ্রমী উদ্যোক্তা এবং সাধারণ মানুষের আশার প্রতিফলন নেই বাজেটে: হোসেন জিল্লুর
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিপিআরসি’র নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, অর্থমন্ত্রী বাজেটে তিন পক্ষের আশার প্রতিফলন দেখিয়েছেন। তবে জনকল্যাণে তেমন কিছু নেই। আইএমএফ, দ্বিতীয় অলিগার্ক তথা সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে যারা ফুলেফেঁপে উঠেছে এবং আমলাতন্ত্র। তবে শোনা হয়নি পরিশ্রমী উদ্যোক্তা এবং অর্থনৈতিক কর্মী তথা সাধারণ মানুষের কথা। হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব গতবছর পর্যন্ত অর্থনৈতিক সংকট স্বীকারই করেননি। ধাক্কা খাওয়ার পর এখন কিছুটা সমস্যার কথা বলছেন। বেশির ভাগ দেশ যখন সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে আমরা নয়-ছয় সীমা আরোপ করেছি। দুর্নীতি এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। সার্বিক নৈতিকতার ব্যাপক অধঃপতন হয়েছে। নৈতিকতা ফিরিয়ে আনতে না পারলে সংকট আরও গভীর হবে।
পরিস্থিতির উন্নয়নে প্রশাসনিক সংস্কার, ব্যাংকিং কমিশন গঠন ও অর্থনীতিবদের নিয়ে প্রবৃদ্ধি অর্জনের কৌশল নির্ধারণে পুনর্মূল্যায়ন করা যেতে পারে। পিপিআরসি’র নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, দরিদ্রদের পাশাপাশি এখন নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তরাও মূল্যস্ফীতি নিয়ে সংকটে আছেন। বাজেটে বলা হয়েছে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। তবে এজন্য যে, কর্মকৌশল লাগে সেটা কোথায়। কর্মসংস্থানের সংকটে থাকা যুবকদের জন্য বাজেটে কি উদ্যোগ রয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে সাধারণ মানুষের জন্য করমুক্ত আয় সীমা বাড়ানো হয়নি। আবার মোবাইলে কথা বলার ওপর, মোটরসাইকেলে নতুন করে কর বাড়ানো হয়েছে।
রাজস্ব সংগ্রহে ব্যর্থতার কারণে দেশ দেউলিয়া হওয়ার পথে: আহসান মনসুর
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক, অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ. মনসুর মনে করেন, শুধুমাত্র রাজস্ব সংগ্রহে ব্যর্থতার কারণে দেশ দেউলিয়া হওয়ার পথে। উচ্চ আয়ের তো পরের কথা, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলে রাজস্ব আয় ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। রাজস্ব খাত এবং আর্থিক খাত সংস্কার অর্থনীতির জন্য এই মুহূর্তে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এ দু’টি খাতের সংস্কার নিয়ে বাজেটে তেমন কিছু বলা হয়নি। তার মতে, সংস্কারের জন্য সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক অঙ্গীকার দরকার।
মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি কমানো বাজেটের বিষয় নয়। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য গত মাসে সুদের হার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। বিনিময় হার বাজারভিত্তিক হওয়ার পথে অগ্রসর হয়েছে। বাজেট মুদ্রানীতির জন্য সহায়ক অবস্থান ঘোষণা করেছে, যা ইতিবাচক। সুদের হার আবার বেঁধে না দিলে এবং টাকা ডলার বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকলে আগামী ৬ থেকে ৯ মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে বলে তিনি মনে করেন। তবে মূল্যস্ফীতি কমবে মানে এই নয় যে, মূল্যস্তর কমবে, মূল্যবৃদ্ধির হার কমবে।