মৃত্যুর খবর শুনলেই গোসল করাতে ছুটে যান ভ্যানচালক ময়নুল

‘২০ বছরে অন্তত ৬০ জনের মরদেহ গোসল করানো ও কবর খোঁড়ার কাজ করেছেন ময়নুল

মৃত্যুর খবর শুনলেই গোসল করাতে ছুটে যান ভ্যানচালক ময়নুল

প্রথম নিউজ, দিনাজপুর: সুস্থ কিংবা অসুস্থ যে কারও সঙ্গেই ময়নুল ইসলামের দেখা হলে আলাপচারিতায় তাকে শুনতে হয়, ‘ময়নুলরে আমার শেষ গোসলটা করাইস। তোর হাতেই যেন শেষ গোসলটা হয়।’ উত্তরে ময়নুল বলেন, ‌‘এইলা কথা কন না। যদি তোমার আগুত মুই মরি যাও। হায়াত মউতের কথা কহা যাইবে নয়।’ ব্যক্তিটি আর কিছু বলতে যাবে গত্যন্তর না দেখে ময়নুল বলে উঠেন, ‘যদি আল্লাহ সুস্থভাবে বাঁচি রাখে তোমহার ইচ্ছা পূরণ হইবে।’

মৃতদের গোসল দেওয়া ছাড়াও প্রায় সময় কবর খোঁড়া ও মরদেহ দাফনের কাজ করে আসছেন ষাট বছর বয়সী ময়নুল ইসলাম। তিনি দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামের বাসিন্দা। একসময় কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও বর্তমানে তিনি ভ্যান চালিয়ে  জীবিকা নির্বাহ করেন। তার আয়ে চলে পাঁচ সদস্যদের পরিবার।

তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে স্বেচ্ছাশ্রমে মৃত ব্যক্তির মরদেহ গোসল দেওয়ার মতো মহৎ কাজটি করছেন ময়নুল ইসলাম। শুধু মৃত ব্যক্তির বেলায় নয়, কারও কোনো অনুষ্ঠান কিংবা কেউ অসুস্থ হলে তার সেবাযত্ন করে পাশে থাকেন ময়নুল। তাকে ডাকতে হয় না, কোনোভাবে জানতে পারলেই সেখানে হাজির তিনি। দায়িত্ব ও কর্তব্যের সংজ্ঞাটা ময়নুলের কাছে খানিকটা অন্যরকম। 

ময়নুল ইসলাম বলেন, ‌‌কারো বিপদ দেখলে বসে থাকতে পারি না। কাউকে হয়ত আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতে পারি না কিন্তু যতটুকু পারি অন্যান্য বিষয়ে পাশে থাকার চেষ্টা করি। সহযোগিতা করে যাচ্ছি কুড়ি বছর ধরে। এজন্য কখনো কারো কাছে কোনো পারিশ্রমিক নিইনি। তবে মনে একটা প্রশান্তি পাই। তিনি আরও বলেন, ‘২০ বছরে অন্তত ৬০ জনের মরদেহ গোসল করানো ও কবর খোঁড়ার কাজ করেছি। এমনও দিন গেছে সকালে গাড়ি নিয়ে বাইর হয়েছি, ফোনে জানতে পেরেছি কারো মারা যাবার কথা। সেদিন আর ভাড়া মারি নাই। সঙ্গে সঙ্গেই ওই ব্যক্তির বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করেছি।’

ময়নুল ইসলাম বলেন, ‌এখন রাস্তায় যে কেউ দেখলে কথা বলে, আমার খোঁজখবর নেন। মানুষ যখন আন্তরিকতা দেখায় তখন গর্বে ও আনন্দে বুকটা ভরে উঠে। তবে খুব কষ্ট হয় যখন দেখি একটা মানুষের সঙ্গে দুই দিন আগে কথা হয়েছে অথচ দুই দিন পর মানুষটার মৃত্যুর খবর পেয়েছি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মৃত মানুষদের পাশে থাকতে চাই। আল্লাহ যেন আমাকে সুস্থ রাখে।

ময়নুল ইসলাম বলেন, ‘মৃত ব্যক্তিকে গোসল করানোর নানা নিয়মকানুন আছে। এমনভাবে গোসল করাতে হয় যেন এক চুল পরিমাণ জায়গাও শুকনা না থাকে। অনেক মৃত মানুষকে গোসল করাইছি, কাপড় পরাইছি এবং কবরেও শোয়ায় রাখছি। তবে এক ব্যক্তির চোখগুলো বন্ধ করতে পারছিলাম না। কবরে শোয়ানোর পর অনেকভাবে চেষ্টা করেও যখন চোখগুলো বন্ধ করতে পারিনি তখন খুব ভয় হচ্ছিল। ওই ঘটনার পর কয়েক দিন রাতে ঘুমাতে পারিনি। খেতে পারছিলাম না, শুধু বুক ধক ধক করছিল। তিনি আরও বলেন, পৃথিবীতে কেউ কখনো চিরদিন বেঁচে থাকে না। একদিন আমিও থাকব না। এই কাজটি কঠিন না, তবে মনোবল শক্ত রাখতে হয়। আমাকেও তো কেউ না কেউ কবরে রেখে আসবে। ইতোমধ্যে স্থানীয় ৮-৯ জন যুবককে এই কাজ শিখিয়েছি। তাদের মধ্যে ৪-৫ জন আমাকে গত ছয় বছর থেকে সহযোগিতা করছে। তবে সমস্যায় পড়েছিলাম করোনার সময়। নিজের স্বজনরাও ভয়ে করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির কাছে যায়নি। কিন্তু আমি ভয় পাইনি। আল্লাহর নাম করে মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফনের কাজ করেছি। সেসময় দেখেছি করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিকে গোসল করানোর পরে কয়েক দিন কেউ পাশে ভিড়ত না।

কোনো কিছুর আশায় এমন স্বেচ্ছাশ্রমের কাজ করেন না ময়নুল। আল্লাহর সন্তুষ্টিই তার একমাত্র উদ্দেশ্য। এজন্য অনেকে তাকে পারিশ্রমিক দিতে চান। ময়নুল বলেন, ‘অনেক সময় কাউকে না করতে পারি না। খুশি হয়ে কিছু হাদিয়া দিলে তখন নিতে হয়। এই কাজের মধ্যে আছি বলেই এলাকার মানুষ আমাকে ভালোবাসে। হাটবাজারে দেখা হলে ডাকেন, চা-পান খাওয়ান। তখন আনন্দ হয়, এ ভালোবাসাই আমাকে এ ধরনের স্বেচ্ছাশ্রমের কাজে উৎসাহ দেয়।’

ময়নুল ইসলামের এই মহতী কাজে খুশি এলাকার লোকজন থেকে শুরু জনপ্রতিনিধিরা। বর্তমান সমাজে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়লেও মৃত ব্যক্তির গোসলসহ মরদেহ দাফন-কাফনের জন্য অভিজ্ঞ মানুষ বাড়েনি। ইসলামী শিক্ষায় বেড়ে ওঠা লোকজন এই কাজে এগিয়ে এলেও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ খুবই কম। এমন পরিস্থিতিতে সমাজে স্বেচ্ছাশ্রমে এগিয়ে আসা ময়নুলের মতো মানুষের বেশি প্রয়োজন বলে মনে করেন অনেকেই।

স্থানীয় ইউপি সদস্য জুয়েল শাহ্ বলেন, ‘ময়নুলকে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি, আমার বাসার পাশেই তার বাসা। কেউ মারা গেলেই ময়নুল সেখানে ছুটে যায়। এ কারণে সবাই ময়নুলকে ভালোবাসে। ময়নুল মৃত ব্যক্তির গোসল দেওয়া, কাপড় পরানো থেকে কবর খোঁড়াখুঁড়ি সবই করতে পারেন।’