ব্যাংকে বড় লকারের চাহিদা বাড়ছে

গ্রাহকরা এখন ব্যাংকে গিয়ে বড় লকার ভাড়া নিতে চাচ্ছেন। অনেকে ছোট লকার ছেড়ে দিয়ে জিনিসপত্র স্থানান্তর করছেন বড় লকারে।

ব্যাংকে বড় লকারের চাহিদা বাড়ছে
ব্যাংকে বড় লকারের চাহিদা বাড়ছে

প্রথম নিউজ, ডেস্ক : গ্রাহকরা ব্যাংকের লকার ভাড়া নেন মূলত মূল্যবান দলিল, কাগজপত্র, অলংকারসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংরক্ষণের জন্য। এতদিন দেশের ব্যাংকগুলোয় ছোট ও মাঝারি লকারের চাহিদা ছিল বেশি। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে এর বিপরীত চিত্র। গ্রাহকরা এখন ব্যাংকে গিয়ে বড় লকার ভাড়া নিতে চাচ্ছেন। অনেকে ছোট লকার ছেড়ে দিয়ে জিনিসপত্র স্থানান্তর করছেন বড় লকারে। বর্ধিত এ চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে গ্রাহকদের প্রয়োজনমতো লকার সরবরাহ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। এ অবস্থায় কোনো কোনো ব্যাংক নতুন করে লকারের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। এমনকি কোনো কোনোটি ছোট লকার কেটে বড় লকারেও রূপান্তর করছে।

ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, উত্তরা, বসুন্ধরা, মতিঝিলসহ রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় ব্যাংকের শাখাগুলোয় এখন বড় লকারের চাহিদা বাড়ছে। একই পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে দেশের বিভাগীয় ও গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোয়ও। পরিস্থিতি সামাল দিতে লকার সেবার পরিধি বাড়াচ্ছে ব্যাংকগুলো। এর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ানো হচ্ছে সেবাটির চার্জ বা ফিও।

ভাড়া নেয়া লকারে রাখা পণ্যের যাবতীয় দায়দায়িত্ব গ্রাহকের। সেখানে গ্রাহকরা কী রাখছেন, ব্যাংকের পক্ষে সেটি দেখা বা যাচাইয়ের কোনো সুযোগ নেই। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি লকারের চাবির দুটি অংশ থাকে। একটি অংশ থাকে গ্রাহকের কাছে, বাকি অংশ থাকে ব্যাংকে। লকার খুলতে হলে চাবির দুটি অংশেরই প্রয়োজন হয়। গ্রাহক ব্যাংকে গেলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা চাবির দুটি অংশের সমন্বয়ে লকারের তালা খুলে দেন। গ্রাহক লকার ব্যবহারের সময় সেখানে কারো উপস্থিত থাকার সুযোগ থাকে না।

অভিযোগ উঠেছে, লকারে কী আছে সেটি দেখার সুযোগ না থাকায় অনেক গ্রাহক সেবাটির অপব্যবহার করছেন। লকারে নগদ ডলারসহ বিদেশী মুদ্রা বেশি রাখা হচ্ছে। দেশে ডলার সংকট তীব্র হয়ে ওঠার পেছনে লকারে বিদেশী মুদ্রা রাখার প্রবণতাও এক প্রকার ভূমিকা রাখছে। ডলার, স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র রাখার কারণেই ব্যাংকগুলোয় বড় লকারের চাহিদা বাড়ছে বলে মনে করছেন ব্যাংক খাতের পর্যবেক্ষকরা।

ব্যাংকে বড় লকারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুুবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বড় লকারের চাহিদা অনেক বেড়েছে। আগে ছোট ও মাঝারি লকারের চাহিদা বেশি ছিল। কিন্তু সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, ছোট ও মাঝারিগুলো ছেড়ে দিয়ে অনেকেই বড় লকার ভাড়া নিতে চাচ্ছেন। নতুন করে যারা এ সেবা নিতে আসছেন, তারাও বড় লকার চান। চাহিদা এতটাই বেড়েছে যে, আমরা সবাইকে বড় লকার ভাড়াও দিতে পারছি না।’

বড় লকারের এ চাহিদা হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে কোনো তথ্য ব্যাংকগুলোর কাছে নেই জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘গ্রাহক লকারে কী রাখছেন, সেটি ব্যাংকের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে নীতিমালা হলো, লকারে থাকা জিনিসপত্রের দায়দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের। এখন গ্রাহকরা যদি আইনে অনুমোদিত নয় এমন সব জিনিসপত্রও লকারে রাখেন তাহলে ব্যাংকারদের কিছু করার নেই।’

দেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মোটামুটি প্রায় সবগুলোরই লকার সেবা রয়েছে। তবে যেসব ব্যাংকের রিটেইল সেবার বিস্তৃতি ও গ্রাহকের সংখ্যা বেশি, সেগুলো লকার সেবার দিক থেকে বেশ এগিয়ে। স্বাধীনতার পর থেকেই দেশের ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের লকার সেবা দিয়ে আসছে। এর মধ্যে সেবাটির সবচেয়ে বেশি বিস্তার হয়েছে গত দুই দশকে।

রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ৫৪টি শাখায় লকার সেবা রয়েছে। ব্যাংকটির ছোট লকারের বার্ষিক চার্জ ২ হাজার টাকা। মাঝারি ও বড় লকারের চার্জ যথাক্রমে ২ হাজার ৫০০ ও ৩ হাজার টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য ব্যাংকগুলোও প্রায় একই চার্জে গ্রাহকদের লকার সেবা দিচ্ছে। তবে বেসরকারি ও বিদেশী খাতের ব্যাংকগুলোর লকার চার্জ অনেক বেশি। যেমন ছোট লকারের জন্য ৫ হাজার, মাঝারির জন্য ১০ হাজার ও বড় লকারের জন্য ১২ হাজার টাকা বার্ষিক চার্জ নিচ্ছে আইএফআইসি ব্যাংক। বেসরকারি খাতের এ ব্যাংকটির ঢাকায় ১৪টিসহ সারা দেশের মোট ৪১টি শাখায় লকার সেবা রয়েছে।

গ্রাহকদের লকার সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে বেসরকারি খাতের দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটির ৩৬টি শাখায় পাওয়া যাচ্ছে লকার সেবা। সিটি ব্যাংকের শাখা ও প্রধান কার্যালয়ে মোট লকার রয়েছে প্রায় চার হাজার। এর মধ্যে ১ হাজার ৭২৪টি লকার ছোট। এগুলোর মধ্যে বর্তমানে ৫৭৩টি খালি রয়েছে। ছোট লকার খালি থাকলেও ব্যাংকটির বড় লকারের চাহিদা অনেক বেশি। সিটি ব্যাংকের ৯২৩টি বড় লকারের মধ্যে এখন ৭৫৭টিই ভাড়ায় রয়েছে। ছোট লকারের জন্য ৫ হাজার, মাঝারির জন্য ৭ হাজার এবং বড় লকারের জন্য ৯ হাজার টাকা চার্জ আদায় করছে সিটি ব্যাংক।

সিটি ব্যাংকের লকার পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন মো. শফিউল আমিন। ব্যাংকটির হেড অব ব্রাঞ্চেস হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এ ব্যাংকার বণিক বার্তাকে জানান, গত দুই-তিন বছরে বড় লকারের চাহিদা বাড়ছে। বিশেষ করে ঢাকার আবাসিক এলাকাগুলোর শাখায় বড় লকারের চাহিদা বেশি। চাহিদা বাড়ার কারণে আমরা বড় লকারের সংখ্যা বাড়িয়েছি। অন্য ব্যাংকগুলোও বড় লকার বাড়াচ্ছে বলে শুনেছি।

দেশের প্রায় সব ব্যাংক লকার সেবা দিলেও এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে কোনো তথ্য নেই। ব্যাংকগুলোর অন্য সব সম্পদ ও দায় নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পরিদর্শন চালানো হলেও লকার বিষয়ে কোনো তদারকি করা হয় না। দেশে ব্যাংকগুলোর কতটি লকার রয়েছে, কিংবা ঠিক কতজন গ্রাহক লকার সেবা নিচ্ছে, সে বিষয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে কোনো তথ্য নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনের ওপর ভর করে দেশে লকার সেবাটি পরিচালিত হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘লকার সেবার যাবতীয় দায়দায়িত্ব গ্রাহকের। গ্রাহক যখন লকার খুলবেন, তখন সেখানে ব্যাংকের কেউ উপস্থিত থাকার সুযোগ নেই। এখন কোনো গ্রাহক যদি ডলারসহ আইন বিরুদ্ধ কোনো সরঞ্জাম লকারে রাখেন, সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও কিছু করার নেই।’

মেজবাউল হক জানান, লকারে কী আছে, সেটি অনুসন্ধান করতে চাইলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আদালতের অনুমতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের উপস্থিতিতে লকার খুলতে পারে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডেরও (এনবিআর) এ ক্ষমতা রয়েছে।

লকার সেবাটি এতদিন শৃঙ্খলাহীনভাবে সম্প্রসারিত হলেও এখন এটিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী ও শাখা ব্যবস্থাপক জানান, ভারতে লকার সেবার বিষয়ে নীতিমালা জারি হয়েছে। বাংলাদেশে সেবাটির বিস্তৃতি হয়েছে কেবল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনের ওপর ভর করে। লকার সেবাকে আরো বেশি নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত করতে হলে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা দরকার। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একটি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে তদারকি বাড়ানো হলে ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি গ্রাহকরাও লকারের বিষয়ে সতর্ক হবে।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com