বিদেশি বিনিয়োগ কমায় রেকর্ড, বেড়েছে বৈদেশিক ঋণ
২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে দেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বা এফডিআই কমেছে রেকর্ড পরিমাণে।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে আরও একটি দুঃসংবাদ দিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে দেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বা এফডিআই কমেছে রেকর্ড পরিমাণে। একই সময়ে দেশে বিদ্যমান অর্থনৈতিক মন্দা ও তীব্র ডলার সংকটের মধ্যেও দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি। ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে গ্রস এফডিআই কমেছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ, নিট হিসাবে কমেছে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এর বিপরীতে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে ১৩ দশমিক ১০ শতাংশ।
মঙ্গলবার প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ঋণ বিষয়ক এ প্রতিবেদনটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি ৬ মাস পরপর প্রকাশ করে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়- ২০২২ সালে দেশে এফডিআই এসেছিল ৪৮২ কোটি ৭৩ লাখ ডলার। গত ২০২৩ সালে এসেছে ৩৯৬ কোটি ৯৮ লাখ ডলার। ওই এক বছরের ব্যবধানে এফডিআই কমেছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। যা আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় রেকর্ড। অতীতে এত বেশি হারে কখনোই এফডিআই কমেনি। বৈশ্বিক মন্দার কারণে বাংলাদেশে এফডিআই কমেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ২০২১ সালের তুলনায় এফডিআই বেড়েছে মাত্র ২ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২১ সালে এফডিআই এসেছিল ৩৮৮ কোটি ৩৩ লাখ ডলার।
দেশে এফডিআই আনা থেকে দেশ থেকে তুলে নেওয়ার পরিমাণ বাদ দিয়ে নিট এফডিআইয়ের হিসাব করা হয়। নিট হিসাবে এফডিআই ২০২২ সালে এসেছিল ৩৪৭ কোটি ৯৯ লাখ ডলার। ২০২৩ সালে এসেছে ৩০০ কোটি ডলার। এ হিসাবে এফডিআই কমেছে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। তবে ২০২১ সালের তুলনায় নিট এফডিআই বেড়েছে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। ওই বছর নিট এফডিআই এসেছিল ২৮৯ কোটি ৫৬ লাখ ডলার।
এ প্রসঙ্গে বিশ্লেষকরা বলেছেন, বৈশ্বিক মন্দার পাশাপাশি দেশে ডলার সংকট ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দেশি উদ্যোক্তারা যেমন পুজি বিনিয়োগ করছেন না। তেমনি বিদেশি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করছেন না। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে ডলার সংকট নিরসন করতে হবে। মূল্যস্ফীতির হার কমাতে হবে। সুদের হার বেশি থাকলেও বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। বিনিয়োগ আনতে হলে সুদের হারও কমাতে হবে।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত এক বছরের ব্যবধানে বিদেশ থেকে পুঁজি হিসাবে এফডিআই আসার প্রবণতা কমেছে ৩১ শতাংশ। ২০২২ সালে পুঁজি হিসাবে এফডিআই এসেছিল ১০২ কোটি ৬৩ লাখ ডলার। ২০২৩ সালে এসেছে ৭০ কোটি ৫৮ লাখ ডলার। ২০২১ সালের তুলনায় পুঁজি হিসাবে এফডিআই আসার প্রবণতা আরও কম অর্থাৎ ৩৮ শতাংশ কমেছে। ২০২১ সালে পুঁজি হিসাবে এফডিআই এসেছিল ১১৩ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। গত ৩ বছরের মধ্যে গত বছর বিদেশি পুঁজি সবচেয়ে কম এসেছে।
এফডিআইয়ের প্রবাহ কমায় ও দেশ থেকে পুঁজি তুলে নেওয়ায় দেশে এফডিআইয়ের স্থিতিও কমেছে। ২০২২ সালে এফডিআইয়ের স্থিতি ছিল ২ হাজার ৭ কোটি ৫৫ লাখ ডলার। ২০২৩ সালে তা আরও কমে দাঁড়ায় ২ হাজার ৫৪ কোটি ৯২ লাখ ডলারে। আলোচ্য সময়ে নিট এফডিআই কমেছে ৫ দশমিক ১ শতাংশ। ২০২১ সালের তুলনায় এফডিআইয়ের স্থিতি কমেছে আরও বেশি অর্থাৎ ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। ওই বছরে এফডিআইয়ের স্থিতি ছিল ২ হাজার ১৫৮ কোটি ১৯ লাখ ডলার। গত ৩ বছরের মধ্যে এফডিআইয়ের স্থিতি সর্বনিæ পর্যায়ে নেমেছে।
বৈশ্বিক মন্দার কারণে বাংলাদেশের পাশাপাশি আরও অনেক দেশ বা অঞ্চলে এফডিআই কমেছে। মধ্যপ্রাচ্য ও আসিয়ান দেশগুলোতে বিনিয়োগ কমেছে। তবে সার্ক দেশগুলোতে বিনিয়োগ বেড়েছে। সার্ক দেশগুলোতে গড়ে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়লেও বাংলাদেশে রেকর্ড পরিমাণে কমেছে।
এদিকে অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পুঁজি নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পুঁজি নেওয়া হয়েছিল ৬ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। গত বছর নেওয়া হয়েছে ৭ কোটি ৩২ লাখ ডলার। ওই সময়ে দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে ১৩ দশমিক ১০ শতাংশ। বিদেশে বিনিয়োগ করা পুঁজি থেকে অর্জিত মুনাফা দেশে আনার প্রবণতাও কিছুটা বেড়েছে। ২০২২ সালে মুনাফা আনা হয়েছিল ১ কোটি ২১ লাখ ডলার। ২০২৩ সালে আনা হয়েছে ৪ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। ফলে বিদেশে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের পুঁজির স্থিতি কিছুটা কমেছে। ২০২২ সালে স্থিতি ছিল ৪০ কোটি ডলার। ২০২৩ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৩৮ কোটি ডলার। ওই সময়ে স্থিতি কমেছে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগের এই হিসাব শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে যে বিনিয়োগ করা হয়েছে তার ভিত্তিতে করা হয়েছে। এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি পুঁজি বিনিয়োগ করা হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া বা দেশ থেকে টাকা পাচারের মাধ্যমে।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত এক বছরের ব্যবধানে দেশের বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২২ সালে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ৯ হাজার ৬৫২ কোটি ডলার। ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৬৪ কোটি ডলার। ওই সময়ে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেড়েছে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ এবং স্বল্পমেয়াদি ঋণ কমেছে ২৩ দশমিক ২ শতাংশ। মোট ঋণের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৮৬ শতাংশ এবং স্বল্পমেয়াদি ঋণ ১৪ শতাংশ। মোট বৈদেশিক ঋণের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ কম হওয়ায় বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের দিক থেকে ঝুঁকি কম বলে মনে করে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ)। স্বল্পমেয়াদি ঋণের মধ্যে বেসরকারি খাতে বেশি। সরকারি খাতে কম। মোট স্বল্পমেয়াদি ঋণ ১ হাজার ৪২৩ কোটি ডলার। দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৮ হাজার ৬৪১ কোটি ডলার।