প্রশাসক নিয়োগ আ.লীগের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে ‘সাংঘর্ষিক’

একই সঙ্গে জেলা পরিষদের মেয়াদ শেষ হলে পরবর্তী পরিষদ গঠন না হওয়া পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি বা সরকারি কর্মকর্তাকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন কেন অসাংবিধানিক ও অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।

প্রশাসক নিয়োগ আ.লীগের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে ‘সাংঘর্ষিক’
ফাইল ফটো

প্রথম নিউজ, ঢাকা: দেশের ৬১টি জেলা পরিষদে ‘প্রশাসক’ নিয়োগ সংবিধানের লঙ্ঘন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরোধী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মতামত দিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা। একই সঙ্গে জেলা পরিষদের মেয়াদ শেষ হলে পরবর্তী পরিষদ গঠন না হওয়া পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি বা সরকারি কর্মকর্তাকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন কেন অসাংবিধানিক ও অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।

গত ২৭ এপ্রিল স্থানীয় সরকার বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, জেলা পরিষদ আইন, ২০০০ এর ধারা ৫ অনুযায়ী জেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন, ২০২২ অনুযায়ী (সংশোধিত) দেশের ৬১টি জেলা পরিষদের মেয়াদ প্রথম সভার তারিখ থেকে পাঁচ বছর উত্তীর্ণ হওয়ায় পরিষদগুলো বিলুপ্ত হয়েছে। এ অবস্থায় জেলা পরিষদ আইন, ২০০০ এর ধারা ৮২ অনুযায়ী সরকার কর্তৃক প্রশাসক নিয়োগের পূর্ব পর্যন্ত এ আইনের ধারা ৭৫-এর প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রত্যেক জেলা পরিষদের প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা পরিচালনার জন্য বিদায়ী চেয়ারম্যানদের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করা হলো।

একই দিন (২৭ এপ্রিল) হাইকোর্টের বিচারপতি জাফর আহমেদ ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ সংক্রান্ত এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রুল জারি করেন। গত ২৪ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিষদের ৫ নম্বর (সদর থানা) ওয়ার্ডের নির্বাচিত সদস্য ও বাংলাদেশ জেলা পরিষদ মেম্বার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. বাবুল মিয়া রিট আবেদনটি দায়ের করেন।

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার  বলেন, ‘জনপ্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে আমলাদের বসানো হচ্ছে। এর মাধ্যমে সংবিধানকে আমরা নগ্নভাবে লঙ্ঘন করছি। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রজাতন্ত্রই হচ্ছে গণতন্ত্র। গণতন্ত্র মানে কী? গণতন্ত্র হলো সব স্তরে জনগণের প্রতিনিধিদের শাসন। কেন্দ্রে যেমন, তেমনি স্থানীয় পর্যায়েও। স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বদলে যদি অনির্বাচিত প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়, সেটা আর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান থাকল না। এ যুক্তিতেই কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দেওয়া হয়েছে।’

‘তিন মাস অনির্বাচিত প্রতিনিধিরা শাসনকার্য পরিচালনা করবেন, এটা গণতান্ত্রিক নয়। এজন্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়েছে। ওখানে যদি এটা গণতান্ত্রিক না হয় তাহলে স্থানীয় পর্যায়ে কেন গণতান্ত্রিক হবে? গণতন্ত্র মানে সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসন।

‘১১ অনুচ্ছেদে আরও বলা আছে, জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করবে। নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকলে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতে পারে না, নিশ্চিতও হয় না। সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদে বলা আছে, আইন অনুযায়ী প্রত্যেক স্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে শাসনকার্যের ভার দেওয়া হইল। অর্থাৎ উপজেলাতে নির্বাচিত উপজেলা পরিষদ, জেলাতে নির্বাচিত জেলা পরিষদ— তারা শাসনকার্য পরিচালনা করবে। এটা যখন না করা হয়, যখন প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয় তখন সুস্পষ্টভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করা হয়। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, দুঃখজনক।’

আমরা যদি সংবিধান না মানি তাহলে রাষ্ট্রে তো আইনের শাসন থাকল না। আমরা যথেচ্ছাচার করছি। এভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করলে আরও অনেক ক্ষেত্রে করা যায়— বলেন সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।

এর আগে ১৭ এপ্রিল স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, জেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী দেশের ৬১টি জেলা পরিষদের মেয়াদ প্রথম সভার তারিখ থেকে পাঁচ বছর উত্তীর্ণ হওয়ায় পরিষদগুলো বিলুপ্ত হয়েছে। এমতাবস্থায় জেলা পরিষদ আইনের ধারা ৮২ অনুযায়ী সরকারের পক্ষ থেকে প্রশাসক নিয়োগের আগ পর্যন্ত আইনের ধারা ৭৫-এর প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রত্যেক জেলা পরিষদের প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা পরিচালনার জন্য প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা/ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হলো। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে এ আদেশ জারি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, ‘আমরা পাকিস্তানের আইয়ুব খানের শাসনামলে যে মৌলিক গণতন্ত্রের ব্যাপারটা দেখেছিলাম, সেই ধরনের বিষয়টা এখন লক্ষ্য করছি। আসলে জনগণ সরাসরি ভোট দিতে পারছেন না। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যখন ভোট হয় তখন বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে তাদের (জনগণ) কেনা যায়। এটা গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করবে এটা। সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হওয়াটাই আমাদের জন্য ভালো, যদি গণতন্ত্রকে আমরা বিশ্বাস করি।’

‘এটা গণতন্ত্রের মূল্যবোধের পরিপন্থি। সচিবদের কাছে দায়িত্ব দেওয়ার মানে হচ্ছে জনপ্রতিনিধিদের আমরা হেয় করছি। ধীরে ধীরে আমলাতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করছি আমরা। এমনিতে আমাদের বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র অতি বিকাশিত। সেটা আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে। জনগণের প্রতিনিধিদের ধীরে ধীরে দুর্বল করে ফেলা সত্যিই গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। গত ৬ এপ্রিল জেলা পরিষদের মেয়াদ শেষ হলে প্রশাসক নিয়োগের বিধান যুক্ত করে ‘জেলা পরিষদ (সংশোধন) বিল-২০২২’ জাতীয় সংসদে পাস হয়। এর আগে ২৩ জানুয়ারি বিলটি সংসদে তোলার পর তা পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়।

বিলে বলা হয়, জেলা পরিষদের মেয়াদ শেষ হলে পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনায় সরকার প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারবে। প্রস্তাবিত বিলে প্রশাসকের মেয়াদ ছিল না। এ সংক্রান্ত একটি সংশোধনী গ্রহণের মাধ্যমে প্রশাসকের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়। সেখানে মেয়াদ ১৮০ দিনের বেশি হবে না বলে উল্লেখ করা হয়। একই সঙ্গে একাধিকবার কেউ প্রশাসক হতে পারবেন না বলেও উল্লেখ করা হয়। বিলটি পাসের সময় এর বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখেন সংসদ সদস্যরা।

এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, ‘নির্বাচিত প্রতিনিধির পরিবর্তে প্রশাসক নিয়োগ কোনো গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হতে পারে না। এটা বিকল্প পন্থাও নয়। বিকল্প যেহেতু নয় সেহেতু সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগ এসব জেলা পরিষদের নির্বাচন করবে, এটাই স্বাভাবিক। এটা না করে প্রশাসক নিয়োগ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ‘যথাসময়ে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন করতে হবে। কারণ, বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি হচ্ছে তারা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে চায়। এ প্রতিশ্রুতির সঙ্গে প্রশাসক নিয়োগের বিষয়টি সাংঘর্ষিক।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom