পরিবেশ না থাকলেও নির্বাচন করতে চান সিইসি

গতকাল নির্বাচন ভবনে গণমাধ্যমের সম্পাদকদের সঙ্গে ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন: গণমাধ্যমের ভূমিকা, জাতির প্রত্যাশা’ শীর্ষক কর্মশালায় সিইসি এমন মন্তব্য করেন।

পরিবেশ না থাকলেও নির্বাচন করতে চান সিইসি

প্রথম নিউজ, অনলাইন: ভোটের পরিবেশ অনুকূলে না থাকলেও নির্বাচন করতে চান প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল তিনি বলেছেন, নির্বাচনী পরিবেশটা পুরোপুরি অনুকূলে নেই। তবে এর অর্থ এই নয় যে, নির্বাচন করবো না। গতকাল নির্বাচন ভবনে গণমাধ্যমের সম্পাদকদের সঙ্গে ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন: গণমাধ্যমের ভূমিকা, জাতির প্রত্যাশা’ শীর্ষক কর্মশালায় সিইসি এমন মন্তব্য করেন। কর্মশালায় পরিবেশ অনুকূলে না থাকা বিষয়ক সিইসি’র বক্তব্য নিয়ে প্রায় সবাই প্রশ্ন তোলেন। সম্পাদকরা বলেন, এটি সাংঘর্ষিক। কেননা, একদিকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে, অন্যদিকে এমন বক্তব্য দেয়া হয়েছে। এতে দলগুলোর মাঝে ভীতির সৃষ্টি হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, আমি নিজেই টাইপ করতে পারি। সেজন্য হয়তো কিছু ভুলভ্রান্তি হতে পারে। ওখানে যে কথাটি বলেছি, তা খুব আন্তরিকভাবে বলেছি। প্রথম যেদিন দায়িত্ব নিয়েছিলাম, সেদিন থেকেই বাধা দেখছি। আমাদের ফিল্ড যে খুব মসৃণ তা কিন্তু নয়। সেজন্য আমরা আবেদন করেছি, আপনারাও চেষ্টা করেন নির্বাচনের পরিবেশ যেন আরও অনুকূল হয়ে ওঠে। সিইসি বলেন, ভাষাটা হয়তো ভুল হয়ে গেছে। আমি এখনো ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি, পরিবেশটা পুরোপুরি অনুকূলে নেই। তবে এর অর্থ এই নয় যে, নির্বাচন করবো না। আমি নৌকা চালাই। স্রোতের অনুকূলে চালাতে পারি, প্রতিকূলে হলেও আমাকে চালাতে হবে।  

দ্য ডেইলি অবজারভারের সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী সিইসি’র কাছে জানতে চান-আপনি প্রিজাইডিং অফিসারকে বলেছেন, যদি নির্বাচন ঠিকমতো না হয়, তাহলে লিভ ইট। সারা দেশে যদি নির্বাচন ঠিকমতো না হয়, তাহলে আপনি কী করবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, না হলে নির্বাচন হবে না। পুরো দেশের নির্বাচন বন্ধ হয়ে যাবে, আবার হবে। ওই সেন্টারে বন্ধ হয়ে যাবে, আবার করবেন। উই হ্যাভ টু বি ক্যারিজিয়াজ, উই হ্যাভ টু ডু দ্যাট। এর আগে সিইসি তার বক্তব্যে বলেন, ‘ভোটকেন্দ্রে সিইসি হচ্ছেন প্রিজাইডিং অফিসার। তাকে বলা হয়েছে যে, নির্বাচনে অনিয়ম হলে তা প্রতিহত করার উদ্যোগ নেবেন। না পারলে বাইরে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা নেবেন। তারপরও তা প্রতিহত করতে না পারলে সেখান থেকে চলে যাবেন। ওই কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করে দেয়া হবে। পরে সেখানে আবার ভোট হবে। 

এদিকে সভায় সূচনা বক্তব্যে সিইসি বলেন, আমরা চাই রাজনৈতিক পরিবেশটা অনুকূল হয়ে উঠুক। আমার যে প্রত্যাশা ছিল, আজকে ছয় মাস, আট মাস, নয় মাস, এটার সমাধান করতে পারলেন না। দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা সমাধান করতে পারেন না, আমি একা কীভাবে...একটা জিনিস ওভারনাইট সমাধান হবে না।

তিনি বলেন, আমরা দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে কুসুমাস্তীর্ণ কোনো জমিনের উপর দিয়ে চলছি না। সমালোচনা হচ্ছে, অনাস্থার কথা বলছে, সংকটের কথা বলছে। আমরা কোনো দল নই। আমরা নির্বাচন আয়োজন করছি আয়োজক হিসেবে। সে জন্য রাজনৈতিকভাবে অনুকূল পরিবেশের আবেদন প্রথম থেকেই বহাল রেখেছি। প্রত্যাশা প্রথম থেকেই ছিল, এখন অবধি সেই প্রত্যাশিত অনুকূল পরিবেশটুকু হয়ে ওঠেনি। আমরা চাই রাজনৈতিক পরিবেশটা অনুকূল হয়ে উঠুক। আমাদের আরাধ্য কর্মটা সহজ হোক। সেটা আমরা প্রত্যাশা করি।

নির্বাচন কমিশন নিরন্তর আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে সিইসি বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে সংলাপ করেছি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। যারা অনাগ্রহী, আসতে চান না, তাদের প্রতিও আমাদের বিনীত আবেদন ছিল যে, আপনারা আসেন। শেষ পর্যন্ত আমি আধা সরকারি পত্র (ডিও লেটার) দিয়েও সেই দল ও তার প্রতি সহানুভূতিশীল অন্য যেসব দল আছে, তাদের প্রতি আবেদন করেছিলাম। অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় চা খেতে আসেন, আমরা কিন্তু সাড়া পাইনি।

এর মাধ্যমে ইসি দেখাতে চেয়েছিল যে, তারা স্বাধীনভাবে কাজ করছে-এমন মন্তব্য করে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, তাদের (বিএনপিসহ যেসব দল ইসি’র সঙ্গে সংলাপ করেনি) যে রাজনৈতিক কৌশল, সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। সেখানে আমার বলার কিছু নেই। আমরা স্পষ্ট করে জানিয়েছি, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের বা জোটের রাজনৈতিক কৌশল থাকতে পারে, সেটা রাজনৈতিক ইস্যু, নির্বাচন কমিশন ওর মধ্যে অনধিকার চর্চা করবে না। কিন্তু আমরা নিরন্তর আহ্বান জানিয়ে যাবো, আপনারা আসেন, সমস্যার সমাধান হোক। অথবা মাঠে আপনারা বিরাজমান সংকটগুলো নিরসন করুন।
দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, নির্বাচনের পরিবেশ এখনো অনুকূল হয়ে ওঠেনি- এমন বক্তব্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন স্বচ্ছতার ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। আসলেই একটি জটিল ঘটনা ঘটছে। প্রয়োজনে আপনারা রাজনৈতিক দলগুলোকে ১০ বার আমন্ত্রণ জানান। তারা অগ্রাহ্য করলো কিংবা অপমান করলো, ওদিকে দৃষ্টি দিবেন না। জনগণ আপনাকে বিচার করবে যে, আপনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনটাকে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে এর গুরুত্বটা কমে যায়। নির্বাচনে লিগ্যালিটি ও মোরালিটি দুটিই থাকতে হবে। স্বাধীনভাবে কাজ করলে অনেক বাধার সম্মুখীন হবেন। জনগণ দেখবে যে, ওই বাধার মুহূর্তে আপনি কী অবস্থান নিচ্ছেন। আপনি তখন কি লিগ্যাল অ্যান্ড মোরাল রোল প্লে করছেন, না-কি শুধু চাপে পড়ে আনুষ্ঠানিকতা বজায় রাখার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। জনগণ কিন্তু আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে। 

মাহফুজ আনাম বলেন, আপনারা নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদেরকে রিটার্নিং কর্মকর্তা করতে চেয়েছেন। এটি ভালো উদ্যোগ। এখন সাধারণত ডিসিরা রিটার্নিং কর্মকর্তা হয়ে থাকে। ডিসিরা যদিও নির্বাচনকালীন সময় নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকে, কিন্তু ডিসিরা তো জানে যে, নির্বাচনের পরে তারা আবার সরকারের কাছে ফিরে যাবে। 

তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যাতে আরও বলিষ্ঠ হয়। ভোটাররা যাতে নিশ্চিন্তে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারেন, এই ইস্যুগুলো আপনাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এইসব ইস্যুতে আমরা আপনাদের সহায়ক হিসেবে কাজ করবো। আমরা গণমাধ্যম গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। তিনি বলেন, মানুষের আস্থা নির্বাচন কমিশনের উপর অনেক কম। আপনাদের দোষ না। কিন্তু আপনাদের যে ইতিহাস। অতীতের কমিশনের যেই কর্মকাণ্ড আপনাদের ঘাড়ে সেটি আসছে। 

নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, আমাদের যে ধারণাপত্র দিয়েছেন সেখানে বলা হয়েছে যে অবাধ, নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য যে অনুকূল পরিবেশ প্রত্যাশা করা হয়েছিল, সেটি এখনো হয়ে ওঠেনি। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, প্রত্যাশিত সংলাপের মাধ্যমে মতভেদের নিরসন হয়নি। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রধানতম দু’দল স্ব স্ব সিদ্ধান্তে অনড়। আমার কথা হলো যদি আপনারা মনে করে থাকেন এখনো অনুকূল পরিবেশ হয়নি, সেটা এক ধরনের সাংঘর্ষিক কি-না। কারণ আপনারা তফসিল ঘোষণার দিকে যাচ্ছেন। হয়তো আগামী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে তফসিল হতে পারে। যখন তফসিল ঘোষণার পূর্ব মুহূর্তে এই ধরনের বক্তব্য আসে, তখন রাজনৈতিক দলগুলো যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, এর প্রেক্ষিতে তাদের মধ্যে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। 

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ও ইংরেজি দৈনিক ডেইলি অবজারভার পত্রিকার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেছেন, কিছু কিছু সময় সত্য কথাটা না বললেও ভালো। নির্বাচনের আর মাত্র আড়াই মাস আছে। আপনারা বলেছেন নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ এখনো হয়ে ওঠেনি। কেউ যদি বলেন অনুকূল পরিবেশ হয়নি তাহলে নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু হবে? তাই কিছু কিছু বক্তব্য যতই সত্য হোক অনুচ্চারিত থাকাটাই ভালো। 

দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, এই মুহূর্তে পুরো জাতি নির্বাচন কমিশনের দিকে তাকিয়ে আছে। এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু ও সুন্দর ভোট হবে, যেখানে জনগণের প্রত্যাশা প্রতিফলিত হবে। একটি ভালো নির্বাচন- একটি নির্বাচন কমিশনকে অনেকদিন মনে রাখার জন্য ইতিহাস সৃষ্টি করে। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে এমন ভূমিকা পালন করুক যাতে আমরা সাধুবাদ ও অভিনন্দন জানাতে পারি। 

এটিএন বাংলার প্রধান বার্তা সম্পাদক জ.ই. মামুন বলেন, নির্বাচন কমিশন যে স্বীকার করেছে নির্বাচনের পরিবেশ নাই- এটি একটি ভালো বিষয়। ইসি’র সংকটের কথা স্বীকার করছে এজন্য ধন্যবাদ। তিনি বলেন, নির্বাচন যদি সবচেয়ে বড় কর্মকাণ্ড হয়, তাহলে রাজনৈতিক বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কিছুই করণীয় নেই- এটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। 

গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহ?ফুজ আনাম, দ্য ডেইলি অবজারভারের সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী, দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম, বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম, দৈনিক প্রতিদিনের বাংলাদেশ সম্পাদক মোস্তাফিজ শফি, এনটিভির প্রধান সম্পাদক জহিরুল আলম, এটিএন বাংলার প্রধান বার্তা সম্পাদক জ. ই. মামুন, চ্যানেল আইয়ের প্রধান বার্তা সম্পাদক জাহিদ নেওয়াজ খান, নিউজ ২৪-এর নির্বাহী সম্পাদক রাহুল রাহা, চ্যানেল ২৪-এর নির্বাহী পরিচালক তালাত মামুন, মাছরাঙা টেলিভিশনের প্রধান বার্তা সম্পাদক রেজোয়ানুল হক প্রমুখ।