নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে ব্যর্থ ৭ ব্যাংক, ঘাটতি ২৪১৮৯ কোটি টাকা
প্রথম নিউজ, ঢাকা : নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) রাখতে ব্যর্থ হয়েছে সরকারি ও বেসরকারি খাতের সাতটি ব্যাংক। ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখতে পারেনি ব্যাংকগুলো। ডিসেম্বর শেষে এসব ব্যাংকের ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ২৪ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা। পাশাপাশি ব্যাংকে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। এই ঋণ কম দেখাতে বিদ্যমান পরিমাণের বাইরে বিরাট অংকের ঋণ রাইট অফ (অবলোপন) করা হচ্ছে, যেটা ব্যালান্স শিটে অন্তর্ভুক্ত থাকছে না।
ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করপোরেট গভর্ন্যান্স ও খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা। খেলাপি কমাতে ঢালাওভাবে ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না। বরং খেলাপি দূর করতে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় গ্রহীতা ও দাতার ক্ষেত্রে একইভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। আরও কঠোর হতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। একইভাবে প্রভিশন রাখতে না পারলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকির ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
ব্যাংকগুলোকে পরিচালন মুনাফার শূন্য দশমিক ৫ থেকে ৫ শতাংশ সাধারণ ক্যাটাগরির ঋণের বিপরীতে প্রভিশন হিসেবে রাখতে হয়। আর নিম্নমানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ এবং সন্দেহজনক খেলাপি ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ৫০ শতাংশ। তবে প্রতিটি ব্যাংকের জন্য মন্দ বা লোকসান ক্যাটাগরির খেলাপি ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ বা শতভাগ প্রভিশন আলাদা করে রাখার বিধান রয়েছে। প্রভিশন ঘাটতি একটি ব্যাংকের জন্য অশনি সংকেত। কারণ প্রভিশন ঘাটতি ব্যাংকগুলোর দুর্বল আর্থিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরে, যা উচ্চ খেলাপি ঋণের ফল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করা সরকারি-বেসরকারি সাতটি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা। কিছু ব্যাংকে প্রভিশন উদ্বৃত্ত রাখায় ব্যাংক খাতের সার্বিক প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ১৯ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। তবে আগের প্রান্তিকের তুলনায় প্রভিশন ঘাটতি কিছুটা কমেছে। গত সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতের সার্বিক প্রভিশন ঘাটতি ছিল ২৫ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে প্রভিশন ঘাটতি কমেছে ৬ হাজার ১০ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, সবশেষ ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে সবচেয়ে বেশি প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকে। আর্থিক অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার কারণে বর্তমানে আলোচিত ব্যাংকটি। ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির মোট প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা। খেলাপিসহ অন্য ঋণের বিপরীতে ব্যাংকটির প্রভিশনের প্রয়োজন ছিল ১৩ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ব্যাংকটি এক হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা রাখতে সক্ষম হয়েছে।
প্রভিশন ঘাটতির তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক। এ ব্যাংকটিও নানা অনিয়ম ও অবস্থাপনার কারণে বেশ নাজুক অবস্থায়। ডিসেম্বরে এ ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত অপর ব্যাংক অগ্রণী ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। এছাড়া রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রূপালী ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ২ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৩৮৫ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ২৩১ কোটি এবং প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬৭ কোটি টাকা।
ঋণ আদায় করতে ব্যর্থ হচ্ছে ব্যাংক। মন্দ ঋণ দিন দিন বাড়ছে। এসব ঋণে শতভাগ প্রভিশন রাখতে করতে হয়। খেলাপি দূর করতে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় গ্রহীতা ও দাতার ক্ষেত্রে একইভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। আরও কঠোর হতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। একইভাবে প্রভিশন রাখতে না পারলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকির ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।- বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, সদ্য সমাপ্ত ২০২৩ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ১৭ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। বিতরণ করা এসব ঋণের মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। মোট বিতরণ করা ঋণের ৯ শতাংশ খেলাপি। এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা।
সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা বেশি। তবে তার আগের প্রান্তিক অর্থাৎ সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের চেয়ে ৯ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা কমেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। যা তখন বিতরণ করা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছেই। খেলাপি ঋণের বিদ্যমান পরিমাণের বাইরে বিরাট অংকের ঋণ রাইট অফ করা হচ্ছে। একটা বড় অংকের খেলাপি ঋণ বিভিন্ন মেয়াদে রি-শিডিউল করা হয়। এক্ষেত্রে গ্রাহক ঋণ খেলাপি হলেও রি-শিডিউল করার কারণে আর ঋণ খেলাপি গণ্য হচ্ছেন না। অথচ বিশ্বের অনেক দেশে খেলাপি হলে তিনি নানা প্রতিবন্ধকতায় পড়েন। ঋণ খেলাপি বাড়ি ভাড়া নিতে পারেন না, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে পারেন না, সামাজিকভাবেও নানা প্রতিবন্ধকতা থাকে। আমাদের এখানে ঋণ খেলাপি মহা আনন্দে থাকেন।’
তিনি বলেন, ‘ঋণ আদায় করতে ব্যর্থ হচ্ছে ব্যাংক। মন্দ ঋণ দিন দিন বাড়ছে। এসব ঋণে শতভাগ প্রভিশন রাখতে করতে হয়। খেলাপি দূর করতে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় গ্রহীতা ও দাতার ক্ষেত্রে একইভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। আরও কঠোর হতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। একইভাবে প্রভিশন রাখতে না পারলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকির ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।’