নানা অনিয়মে লোকসানের বৃত্তে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক

ব্যাংকটি চলতি অর্থবছরসহ টানা চার অর্থবছর লাভের মুখ দেখেনি

নানা অনিয়মে লোকসানের বৃত্তে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক
রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক

প্রথম নিউজ, রাজশাহী: দেশের ব্যাংকিং খাত খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত। কোনো কোনো ব্যাংক লোকসান কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। কিছু ব্যাংকের অবস্থা নাজুক। লাভের পরিবর্তে লোকসান দিয়েই চলতে হচ্ছে তাদের। দীর্ঘদিন ধরে লোকসান দিয়ে আসা এমনই একটি বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)। ব্যাংকটি চলতি অর্থবছরসহ টানা চার অর্থবছর লাভের মুখ দেখেনি। যা আয় করছে তার চেয়ে ব্যয় করছে বেশি। খুব শিগগিরই লোকসান কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে ব্যাংকটির ঊর্ধ্বতনরা দাবি করলেও এখনও তার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। এর সঙ্গে ব্যাংকটিতে নানা ধরনের অনিয়মের তথ্যও রয়েছে।

ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংকটির মোট ৩৮৩টি শাখা রয়েছে। এর মধ্যে শহরে রয়েছে ৫০টি আর পল্লী শাখা রয়েছে ৩৩৩টি। এসব শাখার মধ্যে ১৫১টি শাখাই লোকসানে রয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা লাভ করে ব্যাংকটি। এরপর টানা চার বছর কোনো লাভের দেখা নেই।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যাংটির আয় ছিল ৫৮৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এর বিপরীতে ব্যয় ছিল ৬২৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। ওই অর্থবছরে ব্যাংকটি লোকসান দেয় ৪৩ কোটি ৯১ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংকটির আয় ছিল ৫৩৭ কোটি ৮২ লাখ টাকা, ব্যয় ছিল ৫৭৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। সে বছরও লোকসান হয় ৩৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা।

সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা আয়ের বিপরীতে ৫৮৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা ব্যয় করে ব্যাংকটি। ফলে লোকসান গুণতে হয় ৩ কোটি ১০ লাখ টাকা। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ২৬ আগস্ট পর্যন্ত ১৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা আয় এবং ১৯ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয় করেছে রাকাব। এ সময়ে ৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে বিশেষায়িত এ ব্যাংকটির।

ব্যাংকটি থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, আমানত সংগ্রহেও পিছিয়ে রয়েছে রাকাব। টানা গত পাঁচ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে ব্যাংকটি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮৫০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জন করেছে ৩৪৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকা যা শতকরা হিসাবে মাত্র ৪১ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯০০ কোটি টাকার আমানত সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আদায় হয় ১৯০ কোটি ৪০ লাখ টাকা যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ২১ শতাংশ।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩১ শতাংশ, ২০১৯-২০ অর্থবছরের ১৯ শতাংশ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৭ শতাংশ আমানত সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে ব্যাংকটি। চলতি অর্থ বছরের ৫০০ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত থাকলেও গত ২৬ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে আদায় হয়েছে মাত্র ৭৬ কোটি টাকা যা মোট হিসাবের মাত্র ১৫ শতাংশ।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে বলেন, ‘সরকারি ব্যাংকগুলো এর আগে সরকার থেকে টাকা নিয়ে পুনরায় অর্থায়ন করে চলতো। দু-তিন বছর থেকে এ কাজটি নেই, পরিবর্তন হয়েছে। এখন পুনরায় অর্থায়নের কোনো ব্যবস্থা নেই। সরকারি ব্যাংকগুলোকে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে নিজেদের অর্থ অর্জন করতে হবে। আয় করে ব্যয় করতে হবে। তবে এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি রাকাব।

অন্যদিকে লোকসান আর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতার পাশাপাশি ব্যাংকটির বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগও উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিশেষ পরিদর্শনে। কোনো আইনের তোয়াক্কা না করেই সামিয়ক বরখাস্ত কর্মকর্তাকে চাকরিতে পুনর্বহাল করেছে রাকাব। যদিও আইন বলছে, ‘আর্থিক সংশ্লেষ আছে এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে সাময়িক বরখাস্ত করা কোনো কর্মকর্তা পরবর্তী পাঁচ বছর পদায়ন করা যাবে না’। এরপরও বরখাস্ত কর্মকর্তাকে চাকরিতে পুনর্বহাল এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এ বিষয়ে কিছু না জানানোকে নিয়মবহির্ভূত কাজ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংকটির মুখ্য কর্মকর্তা মো. আরিফ হোসেন মন্ডলকে ভুয়া ঋণ প্রদান, গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা এবং অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ২০১৮ সালের ২৮ আগস্ট সাময়িক বরখাস্ত করেছিল রাকাব। একই অভিযোগে ব্যাংকটির কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদ-উল-বারিকেও একই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। আর্থিক অনিয়ম সংশ্লিষ্টতায় বরখাস্ত এসব কর্মকর্তাকে পরবর্তী পাঁচ বছর কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন না করার আইন থাকলেও এই দুই কর্মকর্তাদের বেলায় আইন অমান্য করা হয়েছে।

সাময়িক বরখাস্তের আড়াই বছরের মাথায় ২০২০ সালের ৭ জানুয়ারি রাকাবের ৪৮৭তম পর্ষদ সভায় মো. আরিফ হোসেন মন্ডলকে পুনর্বহাল করা হয়। আর সাময়িক বরখাস্তের মাত্র ৬ মাসের মাথায় ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট রাকাবের ৪৮০তম পর্ষদ সভায় সাজ্জাদ-উল-বারিকে পুনর্বহাল করা হয়।

আইন অমান্য করে এ দুই কর্মকর্তাকে চাকরিতে পুনর্বহাল করতে একটি দুষ্ট-চক্রের সঙ্গে মোটা অঙ্কের লেনদেনও হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে ব্যাংটিতে।

সরকারি চাকরিজীবীরা তার যোগদানের তারিখ থেকে প্রতি তিন বছর পরপর ১৫ দিনের ছুটিসহ এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকেন। রাকাবের ঊর্ধ্বতন মুখ্য কর্মকর্তা মুকুল কুমার বর্ধন ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শেখ তৌফিক এলাহী মঞ্জুরিকৃত শ্রান্তি বিনোদন ছুটি আংশিক ভোগের পর আবার তা বাতিল করে অফিসে যোগদান করেন। এ সময়ে তারা লাঞ্চভাতা ভোগ করেন, করেন নানা ঋণ অনিয়ম। তাদের এই ভাতা ভোগ সম্পূর্ণ অবৈধ, বলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ব্যাংকটির লোকসান নিয়ে কথা হয় রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে।

তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি ব্যাংকটিকে ঢেলে সাজাতে। এরই মধ্যে আমাদের ব্যাংক ডিজিটালাইজেশন করা হয়েছে। সরকার সুদহার কমিয়েছে গ্রাহকদের জন্য। সে তুলনায় আমরা ভর্তুকি পাচ্ছি না। তবে আমাদের গত জুন শেষে অপারেটিং লোকসান ৪০ কোটি থেকে ৩ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। আশা করছি আমাদের খেলাপি ঋণ (সিএল) বাড়বে না। সব মিলে বলা যায় আমাদের সব কিছুই রিকভারি হবে, লোকসান হবে না।