নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি অসহায় জনগণ
সংসার চালাতে রীতিমতো গলদ্ঘর্ম অবস্থা নিম্ন ও মধ্যবিত্তের।
প্রথম নিউজ,অনলাইন: নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি দামে জনজীবনে একধরনের বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে। সঙ্গে বেড়েছে সব ধরনের সেবার মূল্য। সংসার চালাতে রীতিমতো গলদ্ঘর্ম অবস্থা নিম্ন ও মধ্যবিত্তের। পরিস্থিতি এমন-একজন ব্যক্তি মাসে ৪০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা আয় করেও চার থেকে পাঁচজনের সংসারের ব্যয় বহন করতে পারছেন না। যারা কিছুটা সঞ্চয় করেছিলেন, তারাও জমানো টাকা ভাঙছেন।
আর নিম্ন-আয়ের মানুষের অবস্থা আরও খারাপ। জীবনসংগ্রামে বেঁচে থাকার তাগিদে কেউ কেউ বাধ্য হয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে আশ্রয় নিচ্ছেন। আবার অনেকে পরিবার-পরিজন গ্রামে পাঠিয়ে নিজে শহরে থাকছেন। সবমিলিয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে সঞ্চয় ভাঙার পাশাপাশি ধারদেনা করাটা এখন একরকম স্থায়ী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এছাড়া খেটে খাওয়া মানুষের অর্থাৎ যারা দিন এনে দিন খান, তাদের কষ্টের সীমা নেই।
এদিকে বছরের ব্যবধানে প্রতি কেজি চিনি কিনতে ক্রেতার ৪০ টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে। প্রতি ডজন (১২ পিস) ডিম কিনতে বেশি খরচ হচ্ছে ২৪ টাকা। কেজিপ্রতি দেশি মুরগি ১০০ এবং ব্রয়লার মুরগি ১০ টাকা বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এছাড়া কেজিপ্রতি পেঁয়াজ ৪৫, রসুন ১৮০, হলুদ ১৬০, আদা ২৮০ এবং মাছ ও গরুর মাংস ১০০ টাকা বেশি দাম দিয়ে ক্রেতার কিনতে হচ্ছে। এছাড়া সব ধরনের সেবার দামও বেড়েছে লাগামহীনভাবে।
মার্চ পর্যন্ত তিন মাসের ব্যবধানে বিদ্যুতের দাম তিন দফায় ৫ শতাংশ করে ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। দুই দফায় বিভিন্ন খাতে গ্যাসের দাম বেড়েছে প্রায় শতভাগ। বেড়েছে জ্বালানি তেলের দামও। এতে শিল্পপণ্যসহ সব ধরনের নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দামও বেড়েছে।
চলমান এই পরিস্থিতিতে স্বল্প-আয়ের মানুষের নিত্যদিনের চাহিদায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কমাতে হচ্ছে ভ্রমণ, শিক্ষা, বিনোদনসহ অন্যান্য খাতের খরচ। এতেও পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায় অনেক মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবার খাবারের বাজেট কমিয়ে দিয়েছে।
রাজধানীর কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকার বাসিন্দা মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, আমি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে মাসে ৪৪ হাজার টাকা বেতন পাই। বাবা, স্ত্রী ও এক ছেলে নিয়ে আমার সংসার। সেখান আমিসহ তাদের খাবার জোগাড় করতে মাসে ৫০ কেজির এক বস্তা চাল ৩ হাজার; ৫ লিটার তেল ৮৫০; বাসা ভাড়া ১৩ হাজার; বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল ৩ হাজার; সবজি, মাছ, ব্রয়লার মুরগিসহ তরকারি ও রান্নার উপকরণ কিনতে ৭ হাজার; সাবান-ডিটারজেন্ট ও শ্যাম্পু ৭০০; মুদি বাজার আরও ২ হাজার এবং মোবাইল টকটাইমে খরচ ও ইন্টারনেট বিল ১১০০ টাকা ব্যয় হয়।
পাশাপাশি সন্তানের শিক্ষাব্যয় ৭ হাজার, পরিবারের যাতায়াত ব্যয় ৫ হাজার এবং মাসে গড়ে চিকিৎসা ব্যয় ২ হাজার টাকা ধরে মোট ৪৪ হাজার ৬৫০ টাকা ব্যয় হয়। তিনি বলেন, সব মিলে আমার বেতন দিয়ে মাস চালাতে পরছি না। ফলে একটু একটু করে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছি। তবে আগে মাঝেমধ্যে সবাইকে নিয়ে ঘুরতে বের হলেও এখন তা পারছি না। বেঁচে থাকতে প্রয়োজনীয় খাবার রান্না ছাড়া কোনো ধরনের ভালোমানের খাবার জুটছে না। এমন পরিস্থিতিতে জীবনধারণ করতেই খুব কষ্ট হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপে বলা হয়েছে, একটি পরিবারে শুধু খাবারের পেছনে মাসে ব্যয় হচ্ছে ৩১ হাজার ৫০০ টাকা, যা ২০১৬ সালে ছিল ১৫ হাজার ৭১৫ টাকা। আর ২০১০ সালে মাসে খরচ হতো ১১ হাজার ২০০ টাকা। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মো. রিয়াজ উদ্দিন জানান, দুই ছেলে, স্ত্রী ও বৃদ্ধ মাকে নিয়ে থাকেন মালিবাগে। বেতন পান ৭১ হাজার ৫০০ টাকা। ২ বছর আগে এ টাকায় বেশ ভালোই চলতেন। কিন্তু এখন আর পারছেন না। সংসারের চাহিদা মেটাতে না পেরে প্রতিমাসেই ধার করছেন।
প্রতিমাসে বাসা ভাড়া ২৪ হাজার টাকা। বড় ছেলে অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। প্রতি সেমিস্টারে (৪ মাস অন্তর) তার খরচ ৩৫ হাজার টাকা। সেক্ষেত্রে মাসে ৮ হাজার ৭০০ টাকা রাখতে হচ্ছে। ছোট ছেলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। মাসে যাতায়াত খরচ ৫ হাজার টাকা। এরপর পরিবারের ৫ সদস্যের জন্য মাসে ৫০ কেজির এক বস্তা চাল কেনা হয়। ৭০ টাকা কেজি দরে বস্তাপ্রতি দাম হয় ৩৫০০ টাকা। মাছ-সবজিসহ অন্যান্য পণ্য কিনতে লাগে ১০ হাজার টাকা।
গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল ৪ হাজার টাকা। পাশাপাশি তেল ১০০০, মুদিপণ্য কিনতে খরচ ৩৩০০, সাবান-শ্যাম্পু ও ডিটারজেন্ট খরচ ১০০০, পরিবারের যাতায়াত ব্যয় ৭০০০, মোবাইল ও ইন্টারনেট বিল ১৫০০ এবং মাসে গড়ে চিকিৎসা ব্যয় ৩০০০ টাকা করে মোট ৭২ হাজার টাকা খরচ হয়। এছাড়া অন্যান্য খরচ বাবদ আরও কমপক্ষে দুই হাজার টাকা খরচ হয়। অর্থাৎ, বেতনের বাইরে আরও ২৫০০ টাকা অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে। তিনি বলেন, ব্যয় মেটাতে গিয়ে সঞ্চয় ভেঙে ধারদেনা করতে হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ব্যয় বাড়ছে। সেই ব্যয়বৃদ্ধি সমস্যা হতো না, যদি একই হারে আয় বাড়ত। বাস্তবতা হচ্ছে-মূল্যস্ফীতি যে হারে বাড়ছে, সেই হারে বাড়ছে না আয়। ১৮ মাস ধরে দেশে এ অবস্থা বিরাজ করছে। এক্ষেত্রে মানুষ টিকে থাকার জন্য সঞ্চয় ভেঙে অথবা ঋণ করে খাচ্ছে। কিন্তু যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন, তাদের তো কোনো সঞ্চয় নেই। কিংবা কেউ ধারও দেন না। এ অবস্থায় তারা আরও খারাপ অবস্থায় আছেন।
নয়াবাজারে কথা হয় দিনমজুর মো. রাসেল মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, যেদিন কাজ পাই, সেদিন কামলা দিয়ে ৬০০-৮০০ টাকা মজুরি পাই, যা চার বছর ধরে একই টাকা। মজুরি বাড়েনি। সব মিলে মাসে ১৫-১৬ হাজার টাকা আয় হয়। আমি ঢাকায় একটি মেসে থাকি। সেখানে ৬ হাজার টাকা দিতে হয়। খাবার ও অন্যান্য খরচ ৩ হাজার টাকা রেখে বাকি টাকা গ্রামে পাঠাই। সব মিলে সামনে কীভাবে সংসার চালাব, বুঝতে পারছি না।
জানতে চাইলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, প্রতিবছর পণ্য ও সেবার দাম বাড়ছে। কিন্তু সেভাবে ক্রেতার আয় বাড়ছে না। আয় না বাড়ায় সাধারণ মানুষের হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেক ক্রেতা অপরিহার্য পণ্য ছাড়া অন্যকিছু কেনা বাদ দিয়েছেন। তাই সংশ্লিষ্টদের উচিত পণ্য ও সেবার দাম কীভাবে কমানো যায়, তা চেষ্টা করা। এজন্য পরিকল্পনা করতে হবে। যেসব পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে, তা সাময়িক সময়ের জন্য আমদানি শুল্ক কমিয়ে সরবরাহ বাড়ানো যেতে পারে। পাশাপাশি দেশে যারা কৃত্রিমভাবে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এতে মূল্য সহনীয় থাকলে সাধারণ মানুষের ব্যয় কিছুটা হলেও কমবে।
প্রসঙ্গত, দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। আগস্টে এ হার দুই অঙ্ক ছুঁইছুঁই করে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে। কিন্তু এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়েনি মজুরি। সার্বিক মজুরি হার বাড়ছে কচ্ছপগতিতে। একই সময়ে এ হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৫৮ শতাংশে। ভোক্তাদের আয়ের তুলনায় ব্যয় ২.৩৪ শতাংশ বেশি। আর এই বাড়তি ব্যয় ভোক্তারা সঞ্চয় ভেঙে নির্বাহ করছেন। যে কারণে সঞ্চয়ে টান পড়েছে। যেসব স্বল্প-আয়ের মানুষের সঞ্চয় নেই, তারা ঋণ করে সংসারের ব্যয়নির্বাহ করছেন।
এছাড়া গত বছরের আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। ২০২১ সালের আগস্টে ছিল ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। কয়েক মাস ধরেই দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ওঠানামার মধ্য দিয়েই যাচ্ছে। এর মধ্যে চলতি বছরের জুলাইয়ে ছিল ৯ দশমিক ৬৯, জুনে ৯ দশমিক ৭৪ এবং মে মাসে ব্যাপক বেড়ে হয়েছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ।