দেড়শ টাকার জন্মসনদের জন্য দিতে হয় অন্তত ৫ হাজার!

সরকার নির্ধারিত ফি ১৫০ টাকা হলেও নানা অজুহাতে গ্রাহককে গুনতে হচ্ছে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত।

দেড়শ টাকার জন্মসনদের জন্য দিতে হয় অন্তত ৫ হাজার!

প্রথম নিউজ, মানিকগঞ্জ: জেলার সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটি ইউনিয়নের নারী উদ্যোক্তা রোকসানা আক্তার ও স্থানীয় ইউপি সদস্য আবুল হোসেনের যোগসাজশে হরহামেশাই জন্মসনদ বাণিজ্য চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

সরকার নির্ধারিত ফি ১৫০ টাকা হলেও নানা অজুহাতে গ্রাহককে গুনতে হচ্ছে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। চাহিদা মাফিক টাকা না দিলে আটকে দেওয়া হয় জন্মসনদ সার্টিফিকেট। আর চাহিদামতো টাকা দিলে তারা পুনরায় কিছু টাকা মিষ্টি খাওয়ার জন্য সম্মানী হিসেবে ফেরতও দেন তারা। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বরাবর বিচার চেয়ে একটি লিখিত অভিযোগও দেওয়া হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার বালিয়াটি ইউনিয়নের চর ভাটারা এলাকার মধ্যবয়সী আমছের আলী তার ছেলের জন্মসনদ নেওয়ার জন্য পরিষদ যান। পরিষদে গেলে নারী উদ্যোক্তা রোকসানা আক্তার সংশ্লিষ্ট ইউপি সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। ইউপি সদস্যের সঙ্গে আমছের আলী যোগাযোগ করলে বিভিন্ন ঝামেলার কথা বলে তার কাছে ১০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। ভুক্তভোগী ৫ হাজার টাকা মেম্বারের হাতে দেন এবং বাকি টাকা জন্মসনদ বের হলে দেবেন বলে জানান। জন্মসনদ দিতে দেরি হওয়ায় মেম্বার তার হাতে ভুয়া একটি জন্মসনদ দেন। আমছের আলীর এক নিকট আত্মীয় অনলাইনে সার্চ দিলে অন্য আরেকজনের জন্মসনদ দেখায়। এই ঘটনাটি জানাজানি হলে কৌশলে ওই ভুয়া জন্মসনদ নিজের কাছে নিয়ে নেন আবুল মেম্বার। পরে আনসার আলীকে ওই মেম্বার নারী উদ্যোক্তা রোকসানা আক্তারের চেম্বারে পাঠান।

গত ৫ অক্টোবর ওই নারী উদ্যোক্তার চেম্বারে গেলে আমছের আলীকে এক সপ্তাহ পরে আসতে বলেন তিনি। এরপর আমছের আলী ১০ অক্টোবরে বাকি ৫ হাজার টাকা নিয়ে দেখা করেন ওই নারী উদ্যোক্তার (রোকসানা আক্তার) সঙ্গে। সেই টাকা রোকসানাকে দিলে তিনি জন্মসনদ দেন এবং মিষ্টি খেতে ৫০০ টাকা ফেরত দেন।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, আমছের আলীর ছেলে আসাদ বেপারীর জন্মসনদে রেজিস্ট্রেশন তারিখ দেখানো হয়েছে ২০০৬ সালের ৩০ মার্চ আর জন্মনিবন্ধনের ইস্যু তারিখ দেখানো হয়েছে ১০১৮ সালের ৭ জুন। অপরদিকে স্থানীয় চেয়ারম্যান মীর সোহেল আহম্মেদ চৌধুরী ও পরিষদের সচিব শামীম রেজার সিল স্বাক্ষর আছে চলতি বছরের ১০ অক্টোবর। কিন্তু আমছের আলীর ছেলে আসাদ বেপারীর জন্মতারিখ দেখানো হয়েছে ২০০০ সালের ১০ মার্চ। অনলাইনে জন্মনিবন্ধন যাওয়ার আগে হাতে লেখা বই ব্যবহার হতো। ওই হাতে লেখা বইয়ে রেজিস্ট্রারে দেখা যায় জন্ম তারিখে ২০০০৫৬১৭০১৯০০২০৫৮ নম্বর সিরিয়ালে অন্য ব্যক্তির নাম। ওই রেজিস্ট্রারে আছে চরভাটারা এলাকার সোনা উল্লাহ ও রাবেয়া বেগমের ছেলে বিলেত বেপারীর নাম এবং তার জন্ম ১৯৫৫ সালের ৮ এপ্রিল। এই নামের ওপর চরভাটারা গ্রামের মো. আমছেল আলী বেপারির ছেলে আসাদ বেপারির জন্মতারিখ দেখানো হয়েছে।

ভুক্তভোগী আমছের আলী বলেন, আমার ছেলের জন্মসনদ নিতে পরিষদে গেলে রোকসানা আক্তার মেম্বার আবুলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। আমি তার কথা মতো মেম্বারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। মেম্বার আমাকে বলে এখন জন্মসনদ উঠাতে অনেক ঝামেলা। তবে ভালো মতো তদবির করতে পারলে দ্রুত পাওয়া যায়। কিন্তু সে জন্য কিছু টাকা খরচ করতে হবে। প্রয়োজন বিধায় আমিও টাকা দিতে রাজি হই। পরে মেম্বার আমাকে ১০ হাজার টাকা দিতে বলেন। তখন কম নিতে অনুরোধ করলে মেম্বার বলেন, আগে ৫ হাজার টাকা দিয়ে বাকি টাকা জন্মসনদ হাতে পাওয়ার পরে দিতে। ওই দিনই তাকে ৫ হাজার টাকা দেই এবং ১০ অক্টোবর বাকি ৫ হাজার টাকা রোকসানা আক্তারের হাতে দেই। পরে রোকসানা আক্তার আমার হাতে জন্মসনদের সার্টিফিকেট তুলে দেন এবং মিষ্টি খাওয়ার জন্য ৫০০ টাকাও দেন।

বালিয়াটি ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডের সাধারণ লোকজন অভিযোগ করেন, টাকা ছাড়া পরিষদ থেকে জন্মসনদ পাওয়া অসম্ভব। অথচ রোকসানার চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিলে দ্রুতই সব কিছু পাওয়া যায়। চাহিদা মাফিক টাকা না দিলে তিনি গ্রাহককে মাসের পর মাস ঘুরান এবং খারাপ ব্যবহার করেন। রোকসানার এমন ব্যবহার নিয়ে অনেকবার মৌখিক ও লিখিত অভিযোগ দিয়েও পরিষদ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

অভিযুক্ত বালিয়াটি ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার আবুল হোসেন বলেন, আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। তবে আমি শুনেছি পরিষদের নারী উদ্যোক্তা রোকসানা আক্তার বেশ কিছু টাকা নিয়েছেন। অন্যদিকে রোকসানা আক্তার পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, আমছের আলীর ছেলে আসাদ বেপারীর সংশোধন করার জন্য আমি তার কাছ থেকে সরকারি ফির একশত টাকা নিয়েছি। তার কাছ থেকে কোনো অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয়নি। তবে শুনেছি আবুল মেম্বার কিছু টাকা নিয়েছেন।

বালিয়াটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মীর সোহেল আহম্মেদ চৌধুরী বলেন, আমি নির্বাচিত হওয়ার পর জানতে পারি উদ্যোক্তারা গত দুই বছরের সরকারি ফি কোষাগারে জমা না দিয়ে নিজেদের কাছেই রেখেছিলেন। পরে তারা আমার চাপের মুখে ৪ লাখ ৪১ হাজার টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেন। নারী উদ্যোক্তার বিরুদ্ধে প্রতিনিয়তই নানান অভিযোগ আসে। রোকসানার আক্তারের বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে।

সাটুরিয়ার ইউএনও শান্তা রহমান বলেন, বালিয়াটি ইউনিয়নের নারী উদ্যোক্তার বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগের সত্যতা যাচাই করার জন্য এক সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।