দেশব্যাপী অপরাধ বাড়ছেই, শহর-গ্রাম সবখানে আতঙ্ক

অভিযান চালিয়েও কমানো যাচ্ছে না অপরাধকাণ্ড

দেশব্যাপী অপরাধ বাড়ছেই, শহর-গ্রাম সবখানে আতঙ্ক

প্রথম নিউজ, অনলাইন:  রাজধানীসহ দেশজুড়ে হত্যা, ডাকাতি, অপহরণ ও ছিনতাই, ধর্ষণ, মব সৃষ্টি করে নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। যৌথ বাহিনী, পুলিশ ও র‌্যাবের সাঁড়াশি অভিযানেও থামানো যাচ্ছে না এসব অপরাধ কর্মকাণ্ড। ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিশুকন্যা থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত। আবার লাশবাহী অ্যাম্বুল্যান্স থামিয়ে ডাকাতির মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনাও ঘটছে।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সব ধরনের অপরাধ বাড়ার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে, দেশে পটপরিবর্তনের পর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে অবনতি হয়েছিল, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা তা এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেননি। ফলে অপরাধ কর্মকাণ্ড থামছে না। প্রায়ই চাঞ্চল্যকর অপরাধের ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হচ্ছে। এসব চাঞ্চল্যকর ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ায় দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করলেই দেখা যায়, দিন দিন হত্যা, নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, ডাকাতি, দস্যুতা ও চুরি, ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়ছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে দেশে এক হাজার ১৩৯টি ডাকাতি ও দস্যুতার মামলা হয়েছে, যা গড়ে প্রতি মাসে ২২৮টি। গত বছর প্রতি মাসে এই সংখ্যা ছিল গড়ে ১৫৮। এই পাঁচ মাসে হত্যা মামলা হয়েছে এক হাজার ৫৮৭টি, যা গড়ে প্রতি মাসে ৩১৭টি।

আগের বছর প্রতি মাসে ছিল ২৮৬টি। নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় গত পাঁচ মাসে ৯ হাজার ১০০ মামলা হয়েছে, যা গড়ে প্রতি মাসে এক হাজার ৮২০টি। আগের বছর গড়ে প্রতি মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের আইনে মামলা ছিল এক হাজার ৪৬৪টি। অপহরণের মামলা এই পাঁচ মাসে গড়ে প্রতি মাসে ৮৭টি; গত বছর প্রতি মাসে ছিল ৫৪টি। চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনায় এই পাঁচ মাসের মধ্যে গড়ে প্রতি মাসে ৯৮৫টি মামলা হয়েছে।

গত বছর প্রতি মাসে গড়ে ৯৪৫টি মামলা হয়েছে। অন্যদিকে দায়িত্ব পালন করতে গেলে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনাও বেড়েছে। পাঁচ মাসের মধ্যে গড়ে প্রতি মাসে পুলিশের ওপর ৫৭টি হামলার মামলা হয়েছে; আগের বছর এই সংখ্যা ছিল প্রতি মাসে ৫৪।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কতটা অবনতি হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলো এখনো পুরোপুরি আগের মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে পারছে না।

তাঁরা বলছেন, কোনো অপরাধের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে তখন পুলিশ তা নিয়ে তৎপর হয়। এর বাইরে পুলিশ এখনো মাঠ পর্যায়ে সক্রিয়তার প্রমাণ দিতে পারেনি।

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার কুমিল্লার মুরাদনগরে এক নারীকে ধর্ষণ এবং পরে ঘটনাটির ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করে সর্বস্তরের মানুষ। এর আগের দিন রাতে কুষ্টিয়ার মিরপুরের ছাতিয়ান ইউনিয়নের কালিতলা সড়কে একটি লাশবাহী অ্যাম্বুল্যান্সে সশস্ত্র ডাকাতির ঘটনা ঘটে। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল থেকে আয়েশা খাতুন (৫০) নামের এক নারীর মরদেহ নিয়ে পরিবারের সদস্যরা বাড়ি ফেরার সময় এই ঘটনা ঘটে। এ সময় অ্যাম্বুল্যান্সে থাকা স্বজনদের মারধরের পাশাপাশি তাঁদের স্বর্ণাংলকার ও টাকা লুট করা হয়। অলংকারের জন্য মরদেহেও তল্লাশি চালিয়েছে ডাকাতদল।

এ ছাড়া গতকাল দুপুরে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার হরিপুরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঠিকাদারি নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষে বিরোধের জেরে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ আখ্যা দিয়ে ‘মব’ তৈরি করে মহানগর বিএনপির সাবেক সহসভাপতিকে বিবস্ত্র করে মারধরের ঘটনা ঘটেছে। ভুক্তভোগী ব্যক্তি বন্দর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান। এর আগের দিন গত শনিবার রাত ২টায় জামালপুরের ইসলামপুরে ইউপি সদস্য আবদুর রহিমকে (৪৮) কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। উপজেলার কুলকান্দি ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের যমুনা নদীর দুর্গম চর জিগাতলা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। আবদুর রহিম ওই গ্রামের মৃত তৈয়বুর খন্দকারের ছেলে ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।

নিহতের স্বজন, পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, ঘটনার রাতে একদল লোক প্রশাসনের পরিচয়ে দরজা খুলতে বলে। দরজা না খোলায় ধাক্কাধাক্কি করতে থাকে। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে দরজা খুলে দিলে দুর্বৃত্তরা আবদুর রহিমকে টেনেহিঁচড়ে বের করে উঠানে ফেলে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। পরে দুর্বৃত্তরা যমুনা নদী দিয়ে ট্রলারে করে পালিয়ে যায়। পরিবারের সদস্যরা আবদুর রহিমকে উদ্ধার করতে গেলে তাঁদেরও পিটিয়ে আহত করা হয়। নিহতের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন,  রাতে মুখোশ পরে থাকায় তাঁরা কাউকে চিনতে পারেননি।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিগত কয়েক মাসের চেয়ে এখন তুলনামূলক ভালো। কিভাবে আরো প্রত্যাশিত করা যায়, জনগণকে কিভাবে স্বস্তি দেওয়া যায়, আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’

চাঞ্চল্যকর কয়েকটি ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্যাট্রলিং, টহল টিম মাঠে কাজ করছে। নিয়মিত গোয়েন্দা নজরদারিসহ নানাভাবে কাজ করা হচ্ছে। তবে যেসব ঘটনা ঘটে যায়, সেগুলোতে কিভাবে দ্রুত রেসপন্স করা যায় আমরা চেষ্টা করছি। এসব ঘটনায় আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা জনগণেরও সহায়তা চাই।’

দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি নুর মোহাম্মদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রত্যাশা অনুযায়ী এখনো মনোবল ফেরেনি পুলিশের। তবে পুলিশ চেষ্টা করে যাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখতে।’

হত্যা, ধর্ষণের মতো ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ডের মতো বিষয়গুলোর ভিডিও যাঁরা ছড়িয়ে দিচ্ছেন, তাঁরা এর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্ব বোঝেন না। এটাকে রোধ করতে হবে। সরকার, গণমাধ্যম, সচেতন নাগরিকদের এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘উন্নত দেশগুলোতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিভাবে এ ধরনের ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, সে বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা যেতে পারে। আর কেউ যদি অপরাধের ভিডিও ধারণ করেন, সেটা অবশ্যই ফেসবুকে আপলোড না করে পুলিশকে দেওয়া উচিত। তাহলে পুলিশের তদন্তের জন্য সুবিধা হবে।’

সাম্প্রতিক উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা

ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া স্কুলছাত্রীকে (১৩) রান্নাঘরে রেখে জরুরি প্রয়োজনে পাশের বাড়িতে গিয়েছিলেন মা। এই সুযোগে এলাকার বখাটে বেলাল ওই ছাত্রীর মুখ জাপটে ধরে তাকে ধর্ষণ করতে পাশের ভুট্টাক্ষেতে নিয়ে যায়। কন্যাশিশুটি নিজেকে রক্ষায় চিৎকার করার চেষ্টা করলে তার মুখের ভেতর বালু ও মাটি গুঁজে দেয় বেলাল। এর পরও শিশুটি নিজেকে রক্ষায় ধস্তাধস্তি করলে তার এক হাত ও এক পা মুচড়ে ভেঙে দিয়ে গলা টিপে তাকে হত্যা করে। পরে ভুট্টাক্ষেত থেকে ওই স্কুলছাত্রীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত ১৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের চর শৌলমারী এলাকায় এই নির্মম ঘটনাটি ঘটে।

এদিকে গত বৃহস্পতিবার রাতে খুলনার রূপসা উপজেলার আইচগাতী ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামে এক পক্ষের গুলিতে সাব্বির (২৭) নামের এক যুবক নিহত হন এবং দুজন গুলিবিদ্ধ হন। একই রাতে খুলনা মহানগরীর হরিণটানা থানাধীন রাজবাধ দক্ষিণপাড়ায় বালু ব্যবসায়ী বাবলু দত্তকে (৫০) নির্মমভাবে গলা কেটে হত্যা করা হয়। খুলনার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ধারাবাহিক অবনতির ফলে জেলার মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে।

গত শনিবার গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কাটাবাড়ী ইউনিয়নে ছয় বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে হাবিল মিয়া নামের এক যুবক গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। এর আগে ২৩ ও ২৪ জুন রাজধানীতে তিনটি পৃথক ঘটনায় তিন যুবক খুন হয়েছেন। আধিপত্য বিস্তার, পুরনো বিরোধ ও জমিসংক্রান্ত ঘটনার জেরে খিলগাঁও, পল্লবী ও কামরাঙ্গীর চর এলাকায় এসব ঘটনা ঘটে। নিহত ব্যক্তিরা হলেন মো. সাগর (২২), মো. রিফাত (২২) ও মো. রকি (৩১)।

গত সপ্তাহে চট্টগ্রামের আকবর শাহ থানার বিজয়নগর এলাকায় ১৪ বছর বয়সী এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে রায়হান (৩০) নামের এক যুবককে মারধর করে পুলিশে সোপর্দ করেছে স্থানীয় লোকজন।

গত শনিবার রাতে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার মাঝের দেওর গ্রামের কামাল গাজী নামের এক ব্যক্তি একটি ডিডিও ফেসবুকে পোস্ট করেন। ১৫ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, অন্ধকারের মধ্যে কিছু মানুষ জোর করে এক তরুণীর হাত-পা বাঁধছে। এ সময় ওই তরুণীকে কান্নাকাটি করতে দেখা যায়। তিনি ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করছিলেন। এই ভিডিওটি ফেসবুকে পোস্ট করার পর তা ভাইরাল হয়। ভিডিওতে অভিযোগ করা হয়, তাঁর স্ত্রীকে কিছু মানুষ রাতের আঁধারে তুলে নিয়ে গেছে।