বিএনপি নেতাদের দফায় দফায় চীন সফর, কিসের বার্তা?

প্রথম নিউজ, অনলাইন: গত বছরের আগষ্টে ছাত্র-জনতার এক ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মুখে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে এ পর্যন্ত কয়েক দফায় চীন সফর করেছে দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপির বেশ কয়েকটি প্রতিনিধি দল।
সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দশ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলের চীন সফর করেছে।
শুক্রবার রাতে চীন সফর শেষে দেশে ফিরে বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, চীন সফরের মধ্য দিয়ে দেশটির কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়েছে। বিএনপি প্রতিনিধি দলের এই সফরটিকে রাজনৈতিক অঙ্গনে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে বিএনপি। (প্রতিবেদনটি বিবিসি বাংলা থেকে নেওয়া হয়েছে)
বিএনপির ওই প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, সফরটি খুবই ভালো হয়েছে। সামনে নির্বাচনে আমরা যদি সরকার গঠন করি তাদের যেন প্রবেলেম না হয়, ধারাবাহিকতা যেন থাকে, এগুলো নিয়ে আলাপ হয়েছে। তারাও ইতিবাচক বলেছে। আমরাও ইতিবাচকভাবে দেখছি।
বিএনপি প্রতিনিধি দলের এই সফরটিকে কুটনৈতিকভাবেও বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, বিএনপির উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দলের এই সফর ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করে।
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, প্রথমত চীনকে নিয়ে বাংলাদেশের দলগুলো কী ভাবছে সেটা বোঝার চেষ্টার করা, দ্বিতীয়ত তাদের স্বার্থগুলো আছে সেগুলোর ধারাবাহিকতা কীভাবে থাকবে সেটা নিয়ে আলোচনা করা। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এ নিয়ে তিন দফায় চীন সফরে গিয়েছেন বিএনপি নেতারা।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খানের নেতৃত্বে বিএনপি ও মিত্র রাজনৈতিক দলের একটি প্রতিনিধি দল চীন সফর করে।
এর আগে গত বছর, অর্থাৎ ২০২৪ সালের নভেম্বরে দলের ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান খান রিপনের নেতৃত্বে চীন সফরে যায় বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল। অবশ্য, আওয়ামী লীগের পতন হওয়ার পর বিএনপি ছাড়াও জামায়াত ও আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারাও চীন সফর করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব সফরে শুধু কৌশলগত আলোচনাই নয়, বরং বিএনপি চীনের সঙ্গে নিজেদের রাজনৈতিক যোগাযোগ আরও দৃঢ় করতে চেয়েছে।
চীনের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী হয়েছে
গত ২২ শে জুন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে বিএনপি মহাসচিবের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল চীন সফরে যায়।
এই সফরে আরও ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সেলিমা রহমান, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্যসহ ১০ জন সদস্য।
বিএনপি প্রতিনিধি দলের সদস্যরা চীনের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপমন্ত্রী সান ওয়েইডং, কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগের মন্ত্রী লিউ জিয়ানচাও এবং ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের স্ট্যান্ডিং কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান লি হংঝংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন।
সফর শেষে শুক্রবার রাতে ঢাকায় ফিরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের বলেছেন, চীন সফরে দেশটির সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়েছে।
তিনি বলেন, এই সফরটি ছিল রাজনৈতিক। চীনের আমাদের সফর অত্যন্ত সফল হয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর সঙ্গে অত্যন্ত ফলপ্রসূ ও সফল বৈঠক হয়েছে। পার্টি টু পার্টি সম্পর্ক আরও নিবিড় ও শক্তিশালী হয়েছে।
শুধু কৌশলগত আলোচনাই নয়, বরং বিএনপিও চীনের সঙ্গে নিজেদের রাজনৈতিক যোগাযোগ আরও দৃঢ় করার উদ্যোগ হিসেবেই দেখছে বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, এখানে আমাদের চেয়ে চীনের আগ্রহই বেশি। কারণ বাংলাদেশে চীনের ব্যবসা রয়েছে। সেটা তারা অব্যাহত রাখতে চায়। উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কাজ করতে চায়।
তিনি বলেন, এই সফরে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পলিট ব্যুরোর ডিসিপ্লিনারি কমিটির চেয়ারম্যানের সঙ্গে গ্রেট হলে মিটিং হয়েছে। গ্রেট হলে মিটিং সাধারণত হয় রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানদের সঙ্গে। সুতারং বুঝতে হবে যে এখান তারা আমাদের গুরুত্ব কম দেয়নি।
দলটি বলছে, চীন বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী। আগামীতে নির্বাচনের মাধ্যমে যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসে তাহলে উন্নয়নমূলক কাজের ধারাবাহিকতা থাকে সেটিও চীনের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য।
অর্থনীতি ও ব্যবসায়িক কারণ
গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। এই সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক সম্পর্কও ছিল বেশ ইতিবাচক।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে। যে কারণে চীন বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়।
বাংলাদেশ চীন অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সাহাবুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, চীন বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কৌশলগত ও অর্থনৈতিক অংশীদার। যে কারণে তারা বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে যে আলোচনা করছে সেটা মূলত ইকনোমিক ডিপ্লোম্যাসি।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক কারণে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর, বাংলাদেশে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে দলটি। সে কারণে বিএনপিকেও বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে চীন।
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, অর্থনৈতিক বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই সফরে বিএনপির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আসলে চীন কী চায় সেটাও বিএনপির কানে দিয়ে রাখছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে চীনের যে বিনিয়োগ আছে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করে রেখেছে ভবিষ্যতের নিশ্চয়তার জন্য।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভবিষ্যতে বিএনপি সরকার গঠন করলে যেন এদেশের তাদের বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে কোনো ধরনের সংকট না থাকে সে কারণটিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে চীন।
এটি অবশ্য বিএনপিও মানছে। কেননা, এই সফরে বিএনপির প্রতিনিধি দল যখন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বিভিন্ন বৈঠক করেছে সেখানে এসব বিষয়েও নানা আলোচনা হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, আমরা তাদের এটাও বলেছি যে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না। যে কারণে আমরা তাদের অর্থনৈতিক সহায়তা পুনর্বিবেচনার কথাও বলেছি। আমরা মনে করি চীনও বিষয়গুলোকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছে।
ভূরাজনৈতিক কারণ
সম্প্রতি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে নিয়ে চীনের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে তিন দেশের সমন্বয়ে একটি সম্ভাব্য জোট গঠনের উদ্যোগ দেখা গেছে।
কূটনীতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ উদ্যোগের পেছনে ভারতকে একটা বার্তা দেওয়ার চেষ্টা থাকতে পারে। এমন এক উদ্যোগের মধ্যেই বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে চীন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের একটা অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর চীন এই সুযোগটিকে কৌশলে কাজে লাগাতে চাচ্ছে।
অধ্যাপক সাহাবুল হক বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে সম্পর্কের বৈরিতা চলছে, চীনের জন্য সেটাকে একটি সুযোগও বটে। কেননা, এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে সেটি ভারতের জন্য চাপেরও একটা কারণ।
যে কারণে বিএনপি ও বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনীতির জন্য চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ককে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। যদিও এই প্রশ্নে কিছুটা ভিন্নমত রয়েছে সাবেক কূটনীতিক মুন্সী ফয়েজ আহমদের।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের ও বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক তুলনা করার মতো না। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে যে সব জিনিস গুরুত্ব পায়, চীনের সঙ্গে সম্পর্কে সে সব জিনিস গুরুত্ব পাবে না। সুতরাং একটা দিয়ে আরেকটা পুষিয়ে নেওয়া যায় না।
কারণ হিসেবে ভৌগোলিক অবস্থানের কথা উল্লেখ করে মুন্সী ফয়েজ আহমদ বলছেন, সম্পর্ক স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে ভারতের সঙ্গে। চীনের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা মিললেও, ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রশ্নে ভারত গুরুত্বপর্ণূ। কারণ ভৌগোলিক নিরাপত্তা চীন না, সেটি নিশ্চিত করতে আমাদের ভারতকে প্রয়োজন হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশের বর্তমান অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে চীন শুধু বিএনপি নয়, অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গে যে সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করছে তা মূলত নিজেদের স্বার্থেই বেশি।
বিএনপি মির্জা ফখরুল চীন