গণমাধ্যম কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে
বিশিষ্টজনেরা বলছেন দেশে শক্তিশালী গণতন্ত্র না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এখন পুরোপুরি বিপন্নের পথে। সাংবাদিকরা সত্য লিখতে গেলে, আর সেই সত্য সরকারের বিপক্ষে গেলে হয় গণমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, না হয় সাংবাদিকদের ওপর জুলুম-নির্যাতন নেমে আসছে। যার সর্বশেষ শিকার দৈনিক দিনকাল ও প্রথম আলো।
রাশেদুল হক, প্রথম নিউজ:ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের হিড়িক, গ্রেফতার, নির্যাতন এবং একের পর গণমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়ার কারণে গোটা সাংবাদিক সমাজে আতঙ্ক বিরাজ করছে। নানা অনিয়ম,দুর্নীতি তুলে ধরে খবর প্রকাশ করতে গিয়ে রোষানলে পড়ছে সাংবাদিক সমাজ। সাংবাদিকেদের ওপর নিপীড়ন ও নির্যাতন মানে স্বাধীন মত প্রকাশে বাধা প্রদান। যেটি বর্তমানে প্রতিনিয়ত হচ্ছে। গণমাধ্যম হলো একটি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। গণমাধ্যমের কাজ হলো সমাজের ভুল ত্রুটি ও অসঙ্গতি তুলে ধরা। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গণমাধ্যমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। স্বাধীন গণমাধ্যম গণতন্ত্র, সুশাসন, আইনের শাসন ও জবাবদিহির প্রাণশক্তি। সরকারের খারাপ কাজের সমালোচনা করা মানে রাষ্ট্রের বিরোধিতা নয় কিংবা দেশদ্রোহিতা নয়। বরং সরকারের ভূল ত্রুটির সমালোচনা করলে সেগুলো শোধরানোর সুযোগ পায়। বর্তমানে সে সুযোগটি একেবারেই সংকুচিত হয়ে এসেছে।
বিশিষ্টজনেরা বলছেন দেশে শক্তিশালী গণতন্ত্র না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এখন পুরোপুরি বিপন্নের পথে। সাংবাদিকরা সত্য লিখতে গেলে, আর সেই সত্য সরকারের বিপক্ষে গেলে হয় গণমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, না হয় সাংবাদিকদের ওপর জুলুম-নির্যাতন নেমে আসছে। যার সর্বশেষ শিকার দৈনিক দিনকাল ও প্রথম আলো। ঠুনকো অজুহাত দেখিয়ে দৈনিক দিনকালের ডিক্লারেশন বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। যার কারণে বেকার হয়ে পড়েছেন প্রায় ১৫শ সাংবাদিক। দেশের প্রধান বিরোধী দলের মুখপত্র দৈনিক দিনকাল সরকারের সমালোচনা করে খবর প্রকাশ করে এটাই একমাত্র কারণ। যে কারণে পত্রিকাটির ডিক্লারেশন বাতিল করে দেয়া হয়েছে। আর প্রথম আলোর সম্পাদকসহ রিপোর্টারের বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছে ডিজিটিাল নিরাপত্তা আইনে মামলা। ২৬ মার্চ প্রথম আলো অনলাইনের একটি প্রতিবেদন ফেসবুকে শেয়ারের সময় ‘গ্রাফিক কার্ডে’ ছবির অমিলকে কেন্দ্র করে দেশের ভাবমূর্তি ও অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অভিযোগ এনে মামলা দুটি করা হয়। যদিও ফেসবুকের ওই পোস্টে অসংগতি দ্রুতই নজরে পড়ে এবং তা সরিয়ে নিয়ে সংশোধনী প্রকাশ করা হয়। প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে গভীর রাতে ফিলিম্স্টাইলে সাভারের বাসা থেকে তুলে এনে প্রায় ৪০ ঘন্টা পর আদালতে হাজির করা হয়। তাকে সাভারের বাসা থেকে তুলে এনে শেরে বাংলানগর থেকে গ্রেফতারের নাটক সাজানো হয়। বর্তমানে সে কারাগারে বন্দী। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে নিম্ন আদালত জামিন দিলেও তাকে জামিন দেওয়া হয়নি। বরং কারাবন্দি শামসুজ্জামানকে একবার কেরানীগঞ্জে আরেকবার গাজীপুরের কাশিমপুর কারগারে প্রেরণ করে হয়রানী করা হচ্ছে। এছাড়াও গত দুদিন আগে দৈনিক যুগান্তরের বিশেষ প্রতিনিধি ও ক্রাইম রিপোটার্স এসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহবুব আলম লাবলুর বিরুদ্ধে চট্রগ্রামে ডিটিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে। মামলাটির কারণ তিনি যুবলীগ নেতার দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছেন। একদিকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তাসহ নানা কালো আইনে মামলা দেয়া হচ্ছে অন্যদিকে নানা ডিভাইস বসিয়ে মনিটরিং করা হচ্ছে সাংবাদিকদের। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাংবাদিকতাকে প্রভাবিত করে এমন কতকগুলো আইন হলো: ১.) পেনাল কোড ১৯৬০ (ধারা ৪৯৯-মানহানি); ২.) ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ (ধারা ৯৯, ১০৮, ১৪৪); ৩.) অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩; ৪.) আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩; ৫.) প্রিন্টিং প্রেস ও প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধন) আইন, ১৯৭৩; ৬.) প্রেস কাউন্সিল আইন, ১৯৭৪; ৭.) সংবাদপত্র কর্মচারী (পরিষেবার শর্ত) আইন, ১৯৭৪; ৮.) তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬; ৯.) ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮; ১০.) ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) রেগুলেশন, ২০২১; ১১.) ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্ট বেজড্ সার্ভিস প্রভাইডিং অ্যান্ড অপারেশন পলিসি, ২০২১ (আইসিটি বিভাগ দ্বারা); এবং ১২.) (খসড়া) ম্যাস মিডিয়া কর্মচারী (পরিষেবার শর্তাবলি) আইন ২০২২। এসব আইন প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে। স্বাধীন চিন্তার ওপর নেমে এসেছে খড়্গ। ফলে সাংবাদিক সমাজের মধ্যে ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছে।
বর্তমান সরকারের আমলে সাগর-রুনিসহ প্রায় ৫০জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে ২৫০জনের মতো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। গত কয়েক মাসে ১৯১ টি অনলাইন বন্ধ ও শতাধিক পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করা হয়েছে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সংসদে বলেছেন আরও শতাধিক পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করা হতে পারে। বিশ্ব গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬২তম। প্রতিবেদনটি গত বছরের মে মাসের । এ বছরের প্রতিবেদন এখনও প্রকাশিত হয়নি। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের উপর নির্যাতন নিপীড়ন বন্ধের আহবান জানিয়েছেন জাতিসংঘসহ মানবধিকার ও আর্ন্তজাতিক সংগঠনগুলো। বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক। গত শুক্রবার এক বিবৃতিতে তিনি এই আহ্বান জানিয়েছেন। দেশের বিশিষ্ট জনেরা সাংবাদিক নির্যাতনের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলো সাংবাদিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। কিন্তু এতে সরকারের টনক নড়ছে না। বরং গত কয়েকদিনে সরকারের মন্ত্রীরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পক্ষে জোড়ালোভাবে বক্তব্য রেখেছেন। একই সঙ্গে যে সব সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে তাদের সমালোচনা অব্যাহত রেখেছেন। সরকারের তরফ থেকে স্পষ্ট ভাষায় বলে দেওয়া হয়েছে সরকার বেকায়দায় পরে এমন কোন সংবাদ প্রকাশ করা যাবে না। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ’ অর্থাৎ সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে যেকোনো মূল্যে সুরক্ষা দিতে হবে। আইনি কাঠামো দ্বারা সুরক্ষা না দিলে সাংবাদিক সমাজ প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা নিগৃহীত হতে থাকবে। গণমাধ্যমের উপর নিপীড়ন বন্ধ না করলে তা দেশের জন্য শুভকর হবে না।