কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
এই ঘোষণার পরই কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। আর গতকাল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হয় আন্দোলন। শিক্ষার্থীরা অবিলম্বে কোটা বাতিলের দাবি জানান।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রতিবাদে ফুঁসে উঠছেন শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়েছে আন্দোলন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালের ৪ঠা অক্টোবর সরকারি চাকরিতে নারী কোটা ১০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ এবং জেলা কোটা ১০ শতাংশ বাতিল করে পরিপত্র জারি করেছিল সরকার। যেই পরিপত্রকে বুধবার ‘অবৈধ’ বলে ঘোষণা করে হাইকোর্ট। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের করা এক রিটের প্রেক্ষিতে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় দেন। এই ঘোষণার পরই কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। আর গতকাল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হয় আন্দোলন। শিক্ষার্থীরা অবিলম্বে কোটা বাতিলের দাবি জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক জানান, সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে কোটা বহাল রেখে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বুধবার রায় ঘোষণার পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সেই বিক্ষোভ-প্রতিবাদ অব্যাহত ছিল গতকালও। গতকাল বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন ও সমাবেশ করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কোটা বাতিল চেয়ে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। গতকাল বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়ে কলাভবন, মল চত্বর, ভিসি চত্বর, টিএসসি হয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে শহীদ মিনারে গিয়ে সমাবেশে মিলিত হয়।
মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা বলেন, কোটার বিষয়ে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাহলে ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল রেখে পরে শিক্ষার্থীদের সাঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা হাইকোর্টের এই রায় প্রত্যাখ্যান করলাম। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি অনুরোধ থাকবে তারা যেন এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। যদি সরকারের পক্ষ থেকে আপিল করা না হয় তাহলে আইন এবং রাজপথ দুইভাবেই আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহালকে প্রতারণামূলক আখ্যায়িত করে রাজপথে ও আদালতে লড়াইয়ের মাধ্যমে ষড়যন্ত্র রুখে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতারা। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রাজু ভাস্কর্যের সামনে মানববন্ধনে তারা এ কথা জানান। মানববন্ধনে ছাত্র অধিকার পরিষদের সাবেক আহ্বায়ক হাসান আল মামুন বলেন, যে কোটা ব্যবস্থা ২০১৮ সালে কবর দেয়া হয়েছে, কোনোভাবেই তা ফিরিয়ে আনা যাবে না। কোটা প্রথা ফিরিয়ে আনলে মেধাবীরা যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ পাবে না। আদালতে রায় আদালতে মোকাবিলা করতে আমরা আপিল করবো।
টেলিভিশন ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগের শিক্ষার্থী জালাল আহমদ বলেন, একটি মীমাংসিত বিষয়কে যারা আদালতে নিয়ে গেছেন, আমাদের আন্দোলন তাদের বিরুদ্ধে। কোটা ব্যবস্থা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, কোটা ব্যবস্থা সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। এটি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হলে আমরা আবারো রাজপথে আন্দোলনে নামবো।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা কোটা পদ্ধতি বাতিল ও সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের আদেশের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন। কোটা বাতিল না হলে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি দেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে মিছিল বের করেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে প্রধান ফটক (ডেইরি গেট) সংলগ্ন ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে গিয়ে শেষ হয়। পরে পাঁচ মিনিট মহাসড়ক অবরোধ করে সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের (৪৭তম ব্যাচ) শিক্ষার্থী আরিফ সোহেল বলেন, সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিতের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমাদের এ আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের আন্দোলন।
সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের (৪৯তম ব্যাচ) শিক্ষার্থী তৌহিদ মোহাম্মদ সিয়াম বলেন, শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবিকে প্রত্যাখ্যান করায় আমরা বিক্ষোভ মিছিল ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করছি। কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল হলে আমরা আরও কঠোর কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য হবো।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, বাংলাদেশে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীরা। দাবি পূরণ না হলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন তারা। গতকাল সকাল ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে এ কর্মসূচি পালিত হয়।
এ সময় আইন বিভাগের শিক্ষার্থী সানজিদা বলেন, আমি একজন নারী এবং আমার ১ম শ্রেণির কোটা থাকা সত্ত্বেও আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমার মধ্যে মেধা, দক্ষতা খাকলে আমি প্রথম শ্রেণির চাকরি অর্জন করতে পারবো। তাই মেয়েদের কোনো কোটার দরকার নেই। আমানুল্লাহ আমান বলেন, হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী মোট কোটা আছে ৫৬ শতাংশ আর মেধাবীদের জন্য মাত্র ৪৪ শতাংশ। এটা মেধাবীদের জন্য একটা বৈষম্য। প্রকৃতপক্ষে যে বৈষম্য করা হয়েছিল পাকিস্তান আমলে। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান করি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চাই। তবে কোনোরকম বৈষম্য আমরা মানবো না।
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী আল আমিন বলেন, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও আমি মেধার জোরে চান্স পেয়েছি। কোটার আবেদন করিনি। আমি এই কোটা সংস্কৃতির তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থীরা। এর আগে গত বুধবার রাতে বিক্ষোভ মিছিল করে শিক্ষার্থীরা।
গতকাল বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এতে রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শাহিজুল ইসলাম বলেন, শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন দেশ পেয়েছি। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানাই, তারা দেশের সূর্য সন্তান। কিন্তু তাই বলে তাদের সন্তান এমনকি নাতি-নাতনিরাও পরিশ্রম কম করে কোটার ভিত্তিতে চাকরিতে যোগদান করবে এটা মেনে নেয়া যায় না। সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা কোনো দেশের স্বাভাবিক শিক্ষা ব্যবস্থা হতে পারে না।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, কোটা পুনর্বহাল নিয়ে হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থীরা। গতকাল সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে এ আন্দোলন শুরু হয়। এ সময় শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে পার্কের মোড় হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১নং গেটের সামনে বিক্ষোভ করেন।
বিক্ষোভ শেষে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, একটি রাষ্ট্রে ৫৬ শতাংশ কোটা থাকতে পারে না। তীব্র আন্দোলনের মুখে সরকার যেখানে কোটা পদ্ধতি বাতিল করেছিল হাইকোর্ট কেন সেই কোটাকে আবার পুনর্বহাল করলো আমরা জানি না। সরকারের সিদ্ধান্তকে হাইকোর্ট বাতিল করেছে। আমরা চাইবো সরকারের পক্ষ থেকে যেন আপিল বিভাগে আপিল করা হয় নয় তো আন্দোলন চলবে। আমরা রাজপথ ছাড়বো না।