অবস্থানে অনড় থাকার সিদ্ধান্ত বিএনপির,প্রসঙ্গ রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ,দ্রুত নির্বাচনের চাপ অব্যাহত রাখবে

অবস্থানে অনড় থাকার সিদ্ধান্ত বিএনপির,প্রসঙ্গ রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ,দ্রুত নির্বাচনের চাপ অব্যাহত রাখবে

প্রথম নিউজ, ঢাকা :  রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মোঃ সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ ইস্যুতে অবস্থান পাল্টাবে না বিএনপি। এ ইস্যুতে ইতোমধ্যে সংবিধানের বাইরে না যাওয়ার দলীয় অবস্থানে বহাল থাকবে তারা। সোমবার রাতে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত পুনর্ব্যক্ত করা হয়। বৈঠকে সাংবিধানিক শূন্যতা বা রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয় এমন কোনো উদ্যোগ না নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দলটি। একই সঙ্গে বৈঠকে দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা দিতে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে দলটির রাষ্ট্র সংস্কারে ঘোষিত ৩১ দফা নিয়ে নভেম্বর থেকে গণসংযোগে মাঠে নামারও সিদ্ধান্ত হয়।

বৈঠকে বিএনপি নেতারা বলছেন, বিপ্লব বা অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও সাংবিধানিক পথেই অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। সুতরাং সেই সংবিধানকে উপেক্ষা করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যৌক্তিক হবে না। দলটি মনে করছে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংবিধানকে বাতিল ঘোষণা করা হলে দেশে সাংবিধানিক সংকট বা রাজনৈতিক সংকট তৈরি হবে। এমনটা হলে নির্বাচন আরও পিছিয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা তাদের।

রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ২২ অক্টোবর রাতে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সঙ্গে ভার্চুয়ালি বৈঠক করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠকে নেতারা অভিমত দেন, অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায়   রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা ঠিক হবে না। এমনটা হলে দেশে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে। এতে করে নির্বাচন আরও দীর্ঘায়িত হবে। দলীয় এমন সিদ্ধান্তের আলোকে পরদিন ২৩ অক্টোবর বিএনপির তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল যমুনায় গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে। 

বৈঠকে দলীয় অবস্থান তুলে ধরে বিএনপি নেতারা বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির পদ নিয়ে এই মুহূর্তে দেশে সাংবিধানিক, রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক সংকট তৈরি হোক সেটা কাম্য নয় বিএনপির। দলটি চায় না, দেশে নতুন করে কোনো সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হোক। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক নিয়ে ওই দিন বিকেলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির পদটা একটা সাংবিধানিক পদ বা একটা প্রতিষ্ঠান– সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ। এই পদে হঠাৎ করে পদত্যাগের মাধ্যমে শূন্যতা সৃষ্টি হলে রাষ্ট্রীয় সংকট ও সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে। রাষ্ট্রীয় সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে যদি গণতন্ত্রে উত্তরণের পথটা বিলম্বিত, বাধাগ্রস্ত কিংবা কণ্টকাকীর্ণ হয়, তা জাতির কাম্য নয়।’

এর পর ওই দিন রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। সেখানে রাষ্ট্রপতির অপসারণের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে দলীয় অবস্থান পরিষ্কার করেন বিএনপি নেতারা। তারা বলেন, গণঅভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের পর দেশের সংবিধান স্থগিত করা হয়নি। রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে এখন সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

বিএনপির এমন অবস্থানে রাষ্ট্রপতি অপসারণ ইস্যুতে ছাত্রনেতাদের দাবি কিছুটা থমকে যায়। 

এ পরিস্থিতিতে ইস্যুটি নিয়ে ঐক্য তৈরির চেষ্টায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক শুরু করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা। এর অংশ হিসেবে গত শনিবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন ছাত্রনেতারা। বৈঠকে বিএনপিকে তাদের অবস্থান জানানো হয়, কেন তারা রাষ্ট্রপতির অপসারণ চান, সেটিও তুলে ধরেন। তবে বিএনপি তাদের চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। দলটি তখন জানায়, এ ইস্যুতে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন তারা।

এ প্রেক্ষাপটে সোমবার রাতে লন্ডন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও স্থায়ী কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। সভার প্রধান এজেন্ডা ছিল রাষ্ট্রপতির অপসারণ ইস্যু।

জানা গেছে, সভার শুরুতে রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকের আলোচনা তুলে ধরেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। এর পর নেতারা তাদের অভিমত ব্যক্ত করেন। তারা ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী রাষ্ট্র নতুন করে কোনো ধরনের সংকট বা জটিলতায় পড়ুক– এমন পরিস্থিতি সতর্কভাবে এড়িয়ে চলার অবস্থান প্রকাশ করেন। বিশেষ করে, রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ প্রশ্নে।
সভায় কেউ কেউ বলেন, সম্প্রতি রাষ্ট্রপতির অপসারণ ও প্রক্লেমেশন অব সেকেন্ড রিপাবলিক (দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের ঘোষণাপত্র) ঘোষণাসহ কয়েকটি দাবি তোলা হয়েছে। এ জন্য যদি সংবিধান বাতিল করা হয়, তাহলে দেশে বড় ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে। তারা যুক্তি তুলে ধরে বলেন, সাংবিধানিক সংকট এ জন্য সৃষ্টি হবে, রাষ্ট্রপতি কার কাছে পদত্যাগ করবেন– সে ধরনের কোনো অপশন খোলা নেই। প্রধান বিচারপতিও বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন বলে সভায় একজন জানান।

স্থায়ী কমিটির সভায় বিএনপি নেতারা বলেন, রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে ১০টি কমিশন গঠন করেছে। তারাই মতামত দেবে কী ধরনের সংস্কার হতে পারে রাষ্ট্রের। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া উচিত। বাইরে থেকে নানা ধরনের দাবি তুললে কমিশন ঠিকমতো কাজটা করতে পারবে না।
সভায় এবার ৭ নভেম্বর ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ জাঁকজমকভাবে পালন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওই দিন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের (বীরউত্তম) মাজারে বড় ধরনের শোডাউন করবে দলটি। দেশব্যাপীও বৃহৎ আকারে দিবসটি পালিত হবে। এ উপলক্ষে ঢাকাসহ সারাদেশে জেলা ও মহানগরে ১০ দিনের কর্মসূচি থাকবে। ঢাকায় বড় আকারে শোভাযাত্রা ও আলোচনা সভা হবে।

সভায় মতামত এসেছে, দ্রুততম সময়ে সরকারের উচিত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করা এবং দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের দিকে নজর দেওয়া। বিএনপি আগামী দিনে তাদের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক সব ধরনের কর্মসূচিতে দ্রুত নির্বাচনের ব্যাপারে সোচ্চার হবে। এর মধ্য দিয়ে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে দলটি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থায়ী কমিটির একজন নেতা বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির বিষয়ে সরকার তো বিএনপির কাছে কোনো মতামত চায়নি। ছেলেদের কথায় বিএনপিকে সাড়া দিতে হবে কেন?’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত নির্বাচনী রোডম্যাপ নিয়ে কাজ করা। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্যের দিকে নজর দেওয়া। একই সঙ্গে সাংবিধানিক কোনো শূন্যতা যাতে সৃষ্টি না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখা উচিত।
আগামী মাসে রাজধানী ঢাকাসহ জেলা ও মহানগরে নতুন করে গণসংযোগ কর্মসূচি শুরু করবে। রাষ্ট্র মেরামতের লক্ষ্যে ঘোষিত ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি সামনে রেখে এ কর্মসূচি শুরু করছে দলটি।

দলীয় সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় হঠাৎ বন্যার কারণে রাজনৈতিক কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছিল। এখন আবার নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। ৭ নভেম্বর কেন্দ্রিক কর্মসূচির পর অবস্থা বুঝে সাংগঠনিক কর্মসূচির গতি বাড়ানো বা কমানো হবে।