৩৪৮ কোটি টাকা লুটে নিলেন ঢাকা ওয়াসার ৪৬ কর্মী

সমবায় অধিদপ্তরের তদন্ত উঠে আসে এসব তথ্য।

৩৪৮ কোটি টাকা লুটে নিলেন ঢাকা ওয়াসার ৪৬ কর্মী

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: ঢাকা ওয়াসার ৪৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের ৩৪৮ কোটি ৪৭ লাখ ১ হাজার টাকা লুট করেছেন। এর মধ্যে সংস্থাটির প্রোগ্রাম ফর পারফরম্যান্স ইম্প্রুভমেন্ট (পিপিআই) কমিটির সদস্য পাম্প অপারেটর আশকার ইবনে সায়েক খাজা লোপাট করেছেন ৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকার বেশি। সমবায় অধিদপ্তরের তদন্ত উঠে আসে এসব তথ্য। এরই আলোকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এসব অভিযোগের অনুসন্ধানে নেমেছে। সংস্থাটির পৃথক দুটি টিম এসব অভিযোগ অনুসন্ধান করছে।

জানা গেছে,   ঢাকা ওয়াসার রাজস্ব আদায় কার্যক্রমে সক্ষমতা বাড়াতে পিপিআই কর্মসূচির আওতায় মিটার রিডিং, বিলিং আদায় ও মনিটরিং কার্যক্রম বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালনার শর্ত আরোপ করে। বিশ্বব্যাংকের শর্ত মেনে ঢাকা ওয়াসা এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু করে। যেটি পরে পিপিআই প্রকল্প নামে বাস্তবায়িত হচ্ছে। পিপিআই প্রকল্পের আওতায় সব ধরনের আর্থিক কার্যক্রম পিপিআই পরিচালনা কমিটি সম্পন্ন করেছে। ব্যবস্থাপনা কমিটি কখনই আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনা করেনি। পরবর্তীকালে ২০০৮ সালের ১৬ মার্চ থেকে ২০১৩ সালের ৯ নভেম্বর মেয়াদি ব্যবস্থাপনা কমিটি ও পরিচালনা কমিটি ৮৪ কোটি ৮১ লাখ ৫৮ হাজার ৩৫, ২০১৩ সালের ৯ নভেম্বর থেকে ২০১৬ সালের ১০ মার্চ মেয়াদি কমিটি ৯৪ কোটি ১০ লাখ ১ হাজার ৮৪৫ এবং ২০১৬ সালের ১০ মার্চ থেকে ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর মেয়াদি কমিটি ১৬৯ কোটি ৫৫ লাখ ৪১ হাজার ১২৭ টাকা লোপাট করে।

অর্থাৎ ২০০৮ সালের ১৬ মার্চ থেকে ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে ওয়াসার ৪৬ জন মিলেমিশে মোট ৩৪৮ কোটি ৪৭ লাখ ১ হাজার টাকা লোপাট করেন। ওই তালিকায় আশকার ইবনে সায়েক খাজার নাম রয়েছে। তিনি নিয়েছেন ৬ কোটি ৬৮ লাখ ৫০ হাজার ৩৫৩ টাকা। লোপাট করা টাকা দিয়ে তিনি বাড়ি, গাড়ি ও জমিজমা কিনেছেন। অর্থ লোপাট ছাড়াও তার বিরুদ্ধে প্রভাব খাটিয়ে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিকানা অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। দুদকের তথ্যমতে, কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছেন দুদকের সহকারী পরিচালক রাকিবুল হায়াত।

প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সমিতির সবচেয়ে বেশি টাকা নিয়েছেন সিবিএর সাবেক সভাপতি প্রয়াত হাফিজ উদ্দিন। তিনি নিয়েছেন ৪৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এ ছাড়া পাম্পচালক শামসুজ্জামান ১৩ কোটি ৩৫ লাখ, রাজস্ব পরিদর্শক ছিদ্দিকুর রহমান ১২ কোটি ৯৭ লাখ, আশরাফুল আলম ১১ কোটি ৪৯ লাখ, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আরমান ভূঁইয়া ১১ কোটি ৪৯ লাখ, সহকারী প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম ৯ কোটি ৫৬ লাখ, রাজস্ব পরিদর্শক জাকির হোসেন ৬ কোটি ৬৭ লাখ, সফিকুল ইসলাম ৬ কোটি ৬৭ লাখ এবং গাড়িচালক সংঘের সভাপতি বাবুল আলী ৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা নিয়েছেন। আর অভিযুক্ত অন্যরা ৪ লাখ থেকে ৪ কোটি টাকা পর্যন্ত আত্মসাৎ করেছেন।

সংস্থাটির প্রাথমিক অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় তাকে অভিযোগ অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়। অভিযোগ অনুসন্ধানে ইতিমধ্যে নথিপত্র চেয়ে বিভিন্ন ব্যাংক, বীমা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন, রেজিস্ট্রি অফিস ও ভূমি অফিসসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছেন তিনি। চিঠিতে আশকার ইবনে সায়েক, স্ত্রী নারগিস আক্তার ও তার চার সন্তানের নামে থাকা প্লট, ফ্ল্যাট, ব্যাংক ব্যালান্সসহ স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের তথ্য চেয়েছেন। দুদকের ওই চিঠি পেয়ে বিভিন্ন দপ্তর থেকে দুদকে তথ্য পাঠানো শুরু হয়েছে।

দুদকের টেবিলে থাকা অভিযোগে বলা হয়েছে, আশকার ইবনে সায়েক ওয়াসার জোন-২ (লালবাগ চাঁদনীঘাট)-এর পাম্প অপারেটর। তিনি   ঢাকা ওয়াসার শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন (২৫২২)-এর সাধারণ সম্পাদক। এ ছাড়া শ্রমিক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি। তিনি রাজনৈতিক ও সিবিএর প্রভাব খাটিয়ে কর্মস্থলে কোনো দায়িত্ব পালন করেন না। বিভিন্ন ধরনের সভা-সমাবেশ ও তদবির নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এসব কাজের মাধ্যমে তার পকেটে ঢুকছে কোটি কোটি টাকা। আশকারসহ ওয়াসার কয়েকজন কর্মচারীর বিরুদ্ধে সংস্থাটির ৩৪৮ কোটি টাকার বেশি লোপাটের অভিযোগ রয়েছে।

জানা গেছে,   ঢাকা ওয়াসার কর্মচারী সমিতির টাকা লোপাটের ঘটনা তদন্তে ২০২২ সালের ৬ জুলাই সমবায় অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় সমবায় কার্যালয়ের উপনিবন্ধক মুহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন ঢাকা জেলা সমবায় কার্যালয়ের উপসহকারী নিবন্ধক মো. জহিরুল হক ও পরিদর্শক মো. ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ। তদন্ত কমিটি ২০২৩ সালের ২৪ আগস্ট পর্যন্ত তদন্তকাজ শেষে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। সেই তদন্ত প্রতিবেদন দুদক এবং এ প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে। প্রতিবেদনে ২০০৮ সালের ১৬ মার্চ থেকে ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে তিনটি পিপিআই ব্যবস্থাপনা কমিটির ৪৬ জন মিলেমিশে ৩৪৮ কোটি ৪৭ লাখ ১ হাজার ৭ টাকা লোপাটের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, রাজধানীর কদমতলী থানাধীন মেরাজনগরে বি-ব্লকের ১৬৭ নম্বর হোল্ডিংয়ের স্বজন বিলাস নামের আলিশান বাড়িতে আশকার ইবনে সায়েকের ফ্ল্যাট রয়েছে। একই ভবনে তার শ্যালক শিক্ষানবিশ পাম্প অপারেটর মো. মাসুদের ফ্ল্যাট রয়েছে। আশকার তিনতলা ও মাসুদ চারতলায় পরিবার নিয়ে থাকেন। এ ভবনে ওয়াসার আরও কয়েকজন কর্মচারীর ফ্ল্যাট রয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আশকার ইবনে সায়েক খাজা বলেন, ‘দুদক আমার বক্তব্য নিয়েছে, আমার কাছে যেসব তথ্য চেয়েছে তা জমা দিয়েছি। বিষয়টি দুদক তদন্ত করেছে, করুক।’