২০ প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি সোনালী ব্যাংক

দিনের পর দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি

২০ প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি সোনালী ব্যাংক

প্রথম নিউজ, ঢাকা: শীর্ষ ২০ খেলাপি প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক। ঋণের অর্থও আদায় হচ্ছে না, আবার অর্থ আদায়ে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থাও নিতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে মন্দ ঋণের বোঝা চেপে বসেছে ব্যাংকটির ঘাড়ে। দিনের পর দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি। 

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণের ৩৮ শতাংশ পড়ে আছে ২০ খেলাপি প্রতিষ্ঠানের কাছে। সংকটে পড়ে এখন সরকারের কাছে মূলধন সহায়তা চেয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি। 

সোনালী ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার ৭২১ কোটি ১৩ লাখ টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এর মধ্যে শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছেই পাওনা চার হাজার ৮৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। 

পর্যাপ্ত জামানত না থাকায় এসব খেলাপি গ্রাহকের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের আশা নেই বললেই চলে। ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে পাওনা অর্থ কোনোভাবেই আদায় করতে পারছে না ব্যাংকটি। সেখানে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েও পরিস্থিতির কোনো উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

সংশ্লিষ্টদের মতে, নানা অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে খোয়া যাওয়া এসব টাকা ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারলে অন্তত অনিয়ম কিছুটা কমে আসবে। 

সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপি যারা 

২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণগ্রহীতার তালিকায় শীর্ষে রয়েছে হল-মার্ক গ্রুপ। এর মধ্যে হল-মার্ক সংশ্লিষ্ট টি অ্যান্ড ব্রাদার্সের কাছে খেলাপি ঋণ আছে ৪৯০ কোটি ২৭ লাখ টাকা। 

এছাড়া মেসার্স হল-মার্ক গ্রুপের কাছে খেলাপি ৪৮৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা, তাইপে বাংলা ফেব্রিক্সের কাছে ৩৩১ কোটি ৬০ লাখ টাকা, মেসার্স ফেয়ার অ্যান্ড ফেব্রিক্সের কাছে ৩১৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা, মেসার্স রহমান গ্রুপের কাছে ৩১৪ কোটি তিন লাখ টাকা, মেসার্স লীনা গ্রুপের কাছে ২১৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলসের কাছে ১৮২ কোটি টাকা, এফ আর জুট ট্রেডিং-এর কাছে ১৩১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা, মেসার্স মেঘনা কনডেন্সড মিল্কের কাছে ১৩০ কোটি ৭০ লাখ টাকা, সোনালী জুট মিলের কাছে ১২৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকা, এ কে জুট ট্রেডিং-এর কাছে ১১৭ কোটি পাঁচ লাখ টাকা, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের কাছে ১১৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, মেসার্স এফ আর জুট মিলস লিমিটেডের কাছে ১১২ কোটি চার লাখ টাকা, আব্দুল রাজ্জাক লিমিটেডের কাছে ১০৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা, মেসার্স সুপ্রিম জুট অ্যান্ড নিটেক্স লিমিটেডের কাছে ১০৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা, মেসার্স ইস্টার্ন ট্রেডার্সের কাছে ৯২ কোটি ৬২ লাখ টাকা, ফারুক ডাইং নিটিং-এর কাছে ৯০ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, মেসার্স সানবীম টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের কাছে ৮৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা এবং মেসার্স সাইয়ান কর্পোরেশনের কাছে ৭৬ কোটি সাত লাখ টাকা খেলাপি ঋণ আছে। 

সোনালী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ বড় খেলাপি ঋণ আদায়ে আদালতে মামলা করা হয়েছে। তবে এসব মামলার দীর্ঘসূত্রতা যেমন আছে তেমনি খেলাপিরাও প্রভাবশালী মহলের মাধ্যমে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। ফলে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও খেলাপি ঋণ আদায় করা যাচ্ছে না। 

ব্যাংকটির তথ্য বলছে, চলতি বছর শীর্ষ ২০ খেলাপি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দুই হাজার ২৩২ কোটি ৫০ লাখ টাকা আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু আট মাসে সেই লক্ষ্যের এক শতাংশ অর্থও আদায় করতে পারেনি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত মাত্র দশমিক ৪৩ শতাংশ অর্থাৎ নয় কোটি ৭০ লাখ টাকা আদায় হয়েছে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আতাউর রহমান প্রধান বলেন, ‘শীর্ষ ২০ খেলাপি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংকের ডিএমডি ও জিএমদের সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করা হয়েছে। তারা আবার জিএমদের নিয়ে আলাদা টিম করেছে। এসব টিমকে শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছ থেকে ঋণ আদায়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ‘শীর্ষ ২০ খেলাপি প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগের বিরুদ্ধে মামলা আছে। মামলার মাধ্যমে এখন অর্থ আদায় হচ্ছে। পাশাপাশি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়ও অর্থ আদায়ের চেষ্টা চলছে।’ 

গত আট মাসে খেলাপি ঋণ আদায় এক শতাংশের নিচে থাকার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির এ প্রধান নির্বাহী। 

শুধু সোনালী নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রায় সব ব্যাংকেই অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা চলছে। এখানে প্রভাবশালীদের চাপ ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ঋণ কেলেঙ্কারি হচ্ছে। ব্যাংকের কর্মকর্তারা এসব অনিয়মে সহযোগিতা করছেন। প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুশাসনের অভাব রয়েছে
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শুধু সোনালী নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রায় সব ব্যাংকেই অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা চলছে। এখানে প্রভাবশালীদের চাপ ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ঋণ কেলেঙ্কারি হচ্ছে। ব্যাংকের কর্মকর্তারা এসব অনিয়মে সহযোগিতা করছেন। প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। তাদের তেমন জবাবদিহিতা করতে হয় না।’ 

খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের আগ্রহও কম— জানিয়ে ড. সালেহউদ্দিন বলেন, ‘খেলাপি ঋণ আদায় করতে না পারলে যদি শাস্তি হতো, তাহলে তারা তা অবশ্যই আদায় করত। আদায় করতে না পারলে কোনো সমস্যা হয় না, এ কারণে তারা আগ্রহও দেখায় না।’ 

খেলাপি ঋণ আদায় করতে না পারলে যদি শাস্তি হতো, তাহলে তারা তা অবশ্যই আদায় করতো। আদায় করতে না পারলে কোনো সমস্যা হয় না, এ কারণে তারা আগ্রহও দেখায় না।
এখন যেকোনো উপায় ঋণ আদায় বাড়াতে হবে— এমন পরামর্শ দিয়ে সাবেক এ গভর্নর বলেন, ‘এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাপ থাকতে হবে। পাশাপাশি সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন। একই সঙ্গে সুশাসন নিশ্চিত এবং পর্ষদকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত করতে হবে।’ 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মূলধন সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে অন্যতম রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। ২০২১ সালের জুন শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৫৫৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। 

জানা গেছে, সরকারি ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতিতে পড়লে জাতীয় বাজেট থেকে তার জোগান দিতে হয়। জনগণের করের টাকায় বিভিন্ন সময় মূলধন ঘাটতিতে পড়া ব্যাংকগুলোতে অর্থ জোগান দিয়ে আসছে সরকার। তবে গত কয়েক বছর অর্থনীতিবিদদের বিরোধিতার মুখে এটি বন্ধ রয়েছে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মূলধন সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে অন্যতম রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। ২০২১ সালের জুন শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৫৫৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা
এরপরও মূলধন ঘাটতি পূরণে সরকারের কাছে ১০ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে সোনালী ব্যাংক। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মূলধন ঘাটতি পূরণে বাজেট থেকে নগদ অর্থ না নিয়ে নগদ সহায়তার বিপরীতে সরকারের অনুকূলে শেয়ার ইস্যু বা সরকারি গ্যারান্টিপত্র অথবা নামমাত্র সুদে পারপেচুয়াল (চিরস্থায়ী) বন্ড ইস্যুর প্রস্তাব দিয়েছে সোনালী ব্যাংক। 

নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের জোগান দেওয়া অর্থ ও মুনাফার একটি অংশ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। কোনো ব্যাংক মূলধনে ঘাটতি রেখে তার শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারে না। 

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom