রোহিঙ্গাদের এখনই কাউন্সেলিং নয়: ইউএনএইচসিআরকে সরকার

বাংলাদেশ সরকারের না করা সত্ত্বেও মিয়ানমারে ফিরতে রাজি রোহিঙ্গাদের কাউন্সেলিং করার অভিযোগ উঠেছে ক্যাম্পে দায়িত্বরত জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার বিরুদ্ধে।

রোহিঙ্গাদের এখনই কাউন্সেলিং নয়: ইউএনএইচসিআরকে সরকার

প্রথম নিউজ ডেস্ক: পাইলট প্রকল্পের আওতায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা চলছে। এখনও প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের না করা সত্ত্বেও মিয়ানমারে ফিরতে রাজি রোহিঙ্গাদের কাউন্সেলিং করার অভিযোগ উঠেছে ক্যাম্পে দায়িত্বরত জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার বিরুদ্ধে। এ অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা-ইউএনএইচসিআরকে একটি বার্তা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়, প্রত্যাবাসন ইস্যুতে রোহিঙ্গাদের এখনই যেন কাউন্সেলিং না করা হয়। সময় হলে জাতিসংঘের সংস্থাগুলোকে কাউন্সেলিংয়ের জন্য যুক্ত করা হবে।

কূটনৈতিক সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের কাউন্সেলিংয়ের অভিযোগে বুধবার (১৪ জুন) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার বাংলাদেশ প্রধান ইয়োহানেস ভন ডার ক্লাওকের সঙ্গে বৈঠক করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বৈঠকে ঢাকার পক্ষ থেকে শরণার্থী সংস্থাটিকে বলা হয়েছে, পাইলট প্রকল্পের আওতায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে এখনও সরকার পর্যায়ে আলোচনা চলছে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এখনও আলোচনার সময় আসেনি বা শুরু হয়নি। এমন অবস্থায় যেন জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর ভলানটিয়াররা ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের কাউন্সেলিং করা থেকে বিরত থাকে। শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, গত তিন থেকে চার দিন আগে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার ভলানটিয়াররা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে কোনো প্রশ্ন থাকলে রোহিঙ্গাদের তাদের (ভলানটিয়ারা) সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার বার্তা দিয়েছে। অনেক সংস্থার ভলানটিয়ারা প্রত্যাবাসনে রাজি রোহিঙ্গাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে যোগাযোগ করছে।

সূত্র জানায়, এ ধরনের কর্মকাণ্ডের জন্য আগেও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোকে বার্তা দিয়েছে সরকার। কিন্তু তারা সরকারের নিষেধ অমান্য করে এসব কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যৈষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, প্রত্যাবাসন নিয়ে সরকার এখনও চূড়ান্ত অবস্থানে যায়নি। এখনও প্রত্যাবাসনের তারিখ চূড়ান্ত নয়। সরকার পর্যায়ে আলোচনা চলমান আছে। রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় যেতে চাইলে সরকার জাতিসংঘসহ সবাইকে নিয়ে কাজ শুরু করবে। এ মেসেজটা কিন্তু বারবার সবাইকে দেওয়া হচ্ছে। যখন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন চূড়ান্ত পর্যায়ে যাবে, তখন ইউএনএইচসিআরসহ জাতিসংঘের যারা আছে তারা কাউন্সেলিং করবে। তিনি বলেন, এখন এটা (কাউন্সেলিং) করার মতো অবস্থানে আসেনি। আগে একটা পর্যায়ে যাক, তারপর। রোহিঙ্গাদের কিছু জানার থাকলে তা বাংলাদেশ সরকারের লোকজন জানাবে।

জেনেভার একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ‘মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে প্রত্যাবাসনের পাইলট প্রকল্প’ জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত টম অ্যান্ড্রুসের এমন বিবৃতির প্রতিবাদ করেছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জেনেভার বাংলাদেশ মিশনে প্রতিবাদলিপি পাঠানো হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জেনেভা সফরকালে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অ্যান্ড্রুসের বিবৃতির প্রতিবাদ জাতিসংঘের জেনেভা অফিসকে জানাবে।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূতের বক্তব্য মিথ্যা। সেটাই হয়ত জেনেভা অফিসে কমপ্লেইন করা হবে। বিশেষ দূত বলেছেন, বাংলাদেশ প্রত্যাবাসন নিয়ে মিসগাইড করছে। আমরা প্রত্যাবাসন শুরুই করি নাই, মিসগাইডের প্রশ্ন আসে কোথা থেকে? আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে যেতে রাজি করার কথা বলেছেন, এটাও সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্য। রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফিরে গেলে তাদের প্রাথমিক খরচাটা দিয়েতো পাঠাতে হবে, সেটার সঙ্গে আর্থিক লেনদেন বা মোটা অঙ্কের টাকার কথা একেবারে ঠিক নয়।

গত ৮ জুন পাইলট প্রকল্পের আওতায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন উদ্যোগ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে অ্যান্ড্রুস এক বিবৃতিতে দেন। সেই বিবৃতিতে তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ ‘বিভ্রান্তিমূলক’ এবং ‘বলপ্রয়োগের’ মতো পদক্ষেপের মাধ্যমে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফিরে যেতে বাধ্য করছে। অ্যান্ড্রুস আরও অভিযোগ করেন, শরণার্থীরা ফিরে যেতে রাজি হলে তাদের বিপুল অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতির খবর প্রকাশ পেয়েছে।

জাতিসংঘের বিশেষ দূতের এমন বিবৃতির পরদিন সাংবাদিকদের সঙ্গে এক প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, অ্যান্ড্রুসের কার্যক্রম মিয়ানমারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। তিনি যে বিষয়গুলো বলেছেন এবং যে ভাষায় বলেছেন, এটি আমাদের প্রচেষ্টাকে খাটো করে এবং অসম্মান প্রকাশ করে। অ্যান্ড্রুসের বক্তব্য জাতিসংঘকেও অবহিত করা হবে বলেও জানান প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার।

উল্লেখ্য, চীনের ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগে পাইলট প্রকল্পের আওতায় হাজার খানেকের বেশি রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করতে চায় সরকার। সেই লক্ষ্যে চলতি বছরের এপ্রিলের মাঝামা‌ঝি‌তে চীনের কুনমিংয়ে বাংলা‌দেশ ও মিয়ানমার‌কে নি‌য়ে বৈঠক ক‌রে‌ছে চীন। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় রো‌হিঙ্গা‌দের এক‌টি দল নি‌য়ে সরকা‌রের সং‌শ্লিষ্ট কর্মকর্তারা রাখাই‌ন সফর কর‌বেন।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গত ৫ মে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি ও রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা রাখাইন ঘুরে আসে। ফিরতি সফরে রোহিঙ্গাদের মনোবল বৃদ্ধির জন্য এক সপ্তাহের মধ্যে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশে আসার কথা ছিল। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে প্রতিনিধিদলটির সফর পিছিয়ে যায়। পরে গত ২৫ মে পাইলট প্রকল্পের আওতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনার জন্য মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদল কক্সবাজার ঘুরে গেছে।