রেমালের ভয়ঙ্কর ছোবল উপকূলে

গতকাল রাত ৮টার দিকে ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্র মোংলার দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ উপকূল ও বাংলাদেশের খেপুপাড়া উপকূল অতিক্রম শুরু করে।

রেমালের ভয়ঙ্কর ছোবল উপকূলে

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হেনেছে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় রেমাল। গতকাল রাত ৮টার দিকে ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্র মোংলার দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ উপকূল ও বাংলাদেশের খেপুপাড়া উপকূল অতিক্রম শুরু করে। এ সময় উপকূলীয় এলাকাসমূহে তাণ্ডবলীলা চালায় ঘূর্ণিঝড়টি। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় সেখানকার বাসিন্দাদের। প্লাবিত হয় গ্রামের পর গ্রাম। পানিতে তলিয়ে যায় বসতবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উপসানালয় ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ঘূর্ণিঝড়টি উপকূল ছোঁয়ার আগেই পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় জোয়ারের পানিতে ডুবে এক যুবকের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। মোংলা ও পায়রাসহ ৯ জেলায় ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত, ৪ জেলায় ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়। এ ছাড়াও ১৫ জেলায় ৮-১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। পরিস্থিতি বিবেচনায় আগ থেকেই উপকূলীয় জেলাগুলোতে আশ্রয়কেন্দ্র ও পর্যাপ্ত শুকনা খাবার প্রস্তুত রাখে প্রশাসন। 

ভোর ৫টা পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে বিমান ওঠানামা। আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের উপ-পরিচালক মো. শামীম আহসান রাত সোয়া ৮টার দিকে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ঘূর্ণিঝড়টির আকার প্রায় ৪০০ কিলোমিটার। এর অগ্রভাগ সন্ধ্যা ছয়টার দিকেই খুলনা উপকূলের কাছে সুন্দরবনের দিকে প্রবেশ করে। এর প্রভাবে উপকূলে ব্যাপক বৃষ্টি হচ্ছে। সন্ধ্যায় আবহাওয়া অধিদপ্তরের ১৩নং বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, উত্তরপশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে একই এলাকায় অবস্থান করছে। এটি বিকাল ৩টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৩২৫ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৩১০ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্র বন্দর থেকে ২০০ কি.মি. দক্ষিণে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ১৮০ কি.মি. দক্ষিণে অবস্থান করছিল। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগের প্রভাবে বৃষ্টিসহ দমকা/ ঝড়ো হাওয়া অব্যাহত রয়েছে। প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৬৪ কি.মি. এর মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৯০ কি.মি., যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১২০ কি.মি. পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর বিক্ষুব্ধ রয়েছে। পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরকে ১০ (দশ) নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ১০ (দশ) নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে। এ ছাড়া কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে ৯ (নয়) নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ৯ (নয়) নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার নদী বন্দরসমূহকে ৪ (চার) নম্বর নৌ-মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। প্রবল ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশ ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮ থেকে ১২ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ু তাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। প্রবল ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে দমকা/ঝড়ো হাওয়াসহ ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। অতি ভারী বর্ষণের প্রভাবে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের কোথাও কোথাও ভূমিধস হতে পারে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারসমূহকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হলো। 

এদিকে রেমালের কারণে পানিতে তলিয়ে গেছে সুন্দরবন। পশ্চিম সুন্দরবন বিভাগের কাশিয়বাদ স্টেশন কর্মকর্তা নির্মল কুমার মণ্ডল জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে চার ফুট পানি বেড়ে সুন্দরবন তলিয়ে গেছে। পানির চাপ আরও বাড়বে। তবে বন্যপ্রাণীর ক্ষয়ক্ষতির কোনো আশঙ্কা নেই। সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) এজেডএম হাছানুর বলেন, সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে পুরো সুন্দরবন বিভাগের কর্মকর্তা ও বনরক্ষীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। বনবিভাগের ঝুঁকিপূর্ণ ক্যাম্পগুলোতে থাকা বনরক্ষীদের ইতিমধ্যে নিরাপদে সরিয়ে আনা হয়েছে।

অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড় রেমালে আতঙ্কিত হয়ে উপকূলীয় জেলা বরগুনার চরাঞ্চলের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুম থেকে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষদের মধ্যে খাবার পানি, মুড়ি, চিঁড়া, বিছানা, কম্বল এবং বিদ্যুতের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। রেমালের প্রভাবে বরগুনার পায়রা, বলেশ্বর ও বিষখালী নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জোয়ারের পানি বেড়ে যাওয়ায় প্লাবিত হয়েছে জেলার নিম্নাঞ্চল। ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে গেছে। তলিয়ে গেছে মাছের ঘের। রাস্তা ঘাটে কোমর সমান পানি হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন মানুষ। কুমড়াখালী, আমতলীর আরপাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের পশুরবুনিয়া গ্রামে বেড়িবাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে পুরো গ্রাম। পাউবো তথ্য অনুযায়ী, বরগুনার ৮০৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে নলটোনা, পালের বালিয়াতলী, কালমেঘা, রামনা এবং কালিকাবাড়ী নামক পাঁচটি জায়গায় প্রায় এক কিলোমিটার বাঁধ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। জেলা প্রশাসন জানায়, ৬৪২টি আশ্রয়কেন্দ্র, তিনটি মুজিব কিল্লা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। যেখানে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৫১০ জন মানুষ আশ্রয় নিতে পারবেন। পাশাপাশি ৯ হাজার ৬১৫ জন স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রয়েছেন। জেলার ছয়টি উপজেলায় ছয়টি কন্ট্রোল রুম এবং জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে একটিসহ সাতটি কন্ট্রোল রুম সার্বক্ষণিক খোলা রাখা হয়েছে।

সাতক্ষীরার শ্যামনগরে জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে জেলে পাড়ার ১৩টি বসতবাড়ি। তবে এর আগেই সেখানকার মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়। বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান হাজী নজরুল ইসলাম জানান, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার সকল বাসিন্দাদের দ্রুত সরিয়ে নিতে এখনো কাজ চলছে।

লক্ষ্মীপুরে ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে লক্ষ্মীপুরে বৃষ্টি হচ্ছে। রোববার দুপুরের পর থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ো হওয়া বইছে। এদিকে মেঘনার অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে রামগতি ও কমলনগর উপজেলার ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার পরিবার। ১৫টি গ্রাম হলো- রামগতির চরআবদুল্লাহ, বয়ারচর, তেলিরচর, চরগজারিয়া, বড়খেরী, কমলনগর উপজেলার লুধুয়া, মাতাব্বরহাট, নাছিরগঞ্জ, রায়পুর উপজেলার চরকাচিয়া ও চরখাসিয়া এবং সদর উপজেলার চরমেঘা। দ্বীপচর চরমেঘা থেকে রাতে একশ’ মানুষকে মজুচৌধুরীরহাট আশ্রয়ণ কেন্দ্র নিরাপদে সরিয়ে আনা হয়। এ ছাড়া দ্বীপ চর চরআবদুল্লাহ, চরগজারিয়া, বয়ারচর, তেলির চর, চর মেঘা, চরকাচিয়া ও জরঘাসিয়াসহ বিভিন্ন চরাঞ্চল থেকে মানুষদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে প্রশাসন কাজ করছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত খাবার ও পানির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। 

পটুয়াখালীতে উপকূলীয় এলাকায় প্রবল বাতাস বইছে। জোয়ারের পানিতে কলাপাড়া উপজেলা ধানখালী ইউনিয়নের দেবপুরের বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয়েছে। রাঙ্গাবালী উপজেলা বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার কাজ করছে প্রশাসন। জেলার নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চল এলাকায় পাঁচ থেকে সাত ফুট জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হচ্ছে। মহিপুর মৎস্য আড়ত মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি মো. দিদার উদ্দিন আহম্মেদ মাসুম বলেন, সমুদ্রে মাছ ধরা নিষেধাজ্ঞার কারণে সাগরে কোনো মাছ ধরার ট্রলার নেই। সবাই নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছে। জেলায় ১৫৫টি আশ্রয় কেন্দ্র ২০টি মুজিব কিল্লা প্রস্তুতের পাশাপাশি শিশু খাদ্য ও শুকনা খাবার মজুত রাখা হয়েছে। কুয়াকাটার বহুতল ভবনগুলো দুর্যোগের সময় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়।

এ ছাড়া কলাপাড়ায় রেমালের হাত থেকে ফুপু ও বোনকে রক্ষা করতে গিয়ে মো. শরীফ (২৪) নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। দুপুরে ধুলাসর ইউনিয়নের কাউয়ারচর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। মৃত শরীফ অনন্তপাড়া এলাকার আবদুর রহিমের ছেলে। জানা যায়, শরীফের ফুপু মাতোয়ারা বেগম কাউয়ার চর এলাকায় বসবাস করেন। ওই বাড়িতে তার বোনও ছিল। দুপুর ১টার দিকে অনন্তপাড়া থেকে শরীফ তার বড় ভাই ও ফুপাকে নিয়ে বোন এবং ফুপুকে উদ্ধার করতে যায়। এ সময় সমুদ্রের পানিতে কাউয়ারচর এলাকা ৫ থেকে ৭ ফুট পানিতে প্লাবিত ছিল। সাঁতার কেটে ফুপুর ঘরে যাওয়ার সময় সমুদ্রের ঢেউয়ে পানিতে তলিয়ে যায় শরীফ। এক ঘণ্টা পর ওই স্থান থেকে শরীফের লাশ উদ্ধার করে স্থানীয়রা। ওদিকে বাগেরহাটের শরণখোলায় ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে ৩৫/১ পোল্ডারের বেড়িবাঁধের রাজৈরের কালিয়ার খাল এলাকায় বাঁধ ভেঙে প্রায় ২শ’ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নের তেরাবেকা ওবগী এলাকায় রিং ভেঙে পানি ঢুকে পড়েছে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে রাজৈর এলাকার পাঁচ গ্রাম ও সাউথখালী সাত গ্রামের মানুষের মধ্যে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুদীপ্ত কুমার সিংহ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। উপজেলার চারটি ইউনিয়নে ৯০টি সাইক্লোন সেন্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে।