রোগীর কোটি টাকার ফি লুট, শাস্তির মুখে মিটফোর্ডের ৫ কর্তা
প্রথম নিউজ, ঢাকা: স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল। ২০২২ সালের ১ থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা ও বিভিন্ন পরীক্ষার ফি বাবদ ৩০ লাখ ৭২ হাজার ৪৮ টাকা আদায় হয়। নিয়ম অনুযায়ী তা ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা হওয়ার কথা। দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসাবরক্ষক (ক্যাশিয়ার) মো. আব্দুছ ছাত্তার মিয়া ইউজার ফি জমাও দেন।
কিন্তু ২৬ সেপ্টেম্বর দুটি ট্রেজারি চালানে জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৩০ লাখ এক হাজার ৪৪৮ টাকা। অর্থাৎ তিনি ৭০ হাজার ৬০০ টাকা কম জমা দেন। অভিনব এ কৌশলে অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি ধরা পড়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। ততদিনে সরকারি দুই কোটি ৫৪ লাখ ৪৩ হাজার ৪৪১ টাকা বেহাত হয়ে গেছে। ১১টি ট্রেজারি চালানে একই কৌশলে অর্থ আত্মসাৎ করেন ছাত্তার মিয়া। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে মামলা ও চার্জশিট দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
চার্জশিটে একমাত্র আসামি করা হয় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের হিসাবরক্ষক মো. আব্দুছ ছাত্তার মিয়াকে। পাঁচ মাস ধরে আত্মসাতের এমন ঘটনা ঘটলেও দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীর কি কোনো দায় ছিল না— এমন প্রশ্ন ছিল সংশ্লিষ্টদের মনে। অবশেষে আদালতে চার্জশিট দাখিলের পাশাপাশি এবার সংশ্লিষ্ট পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে দুদক।
কর্মকর্তারা হলেন- স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. মোহাম্মদ আলী হাবিব, সহকারী পরিচালক ডা. মো. মফিজুর রহমান, হিসাবরক্ষক ও ভারপ্রাপ্ত হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. জাহেদুর রহিম, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন ও প্রধান সহকারী মো. আব্দুর রহিম ভূঁইয়া।
গত ১৪ জানুয়ারি স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিবকে দেওয়া চিঠিতে যথাযথভাবে তদারকি না করে দায়িত্ব পালনে অবহেলার কারণে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ এর ৩ (খ) বিধি অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, বিভিন্ন হাসপাতালে ইউজার ফি দেওয়া হয়। সেই ইউজার ফি যথানিয়মে সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে মামলা ও আসামিকে গ্রেপ্তার করে দুদক। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। দায়িত্ব অবহেলার কারণে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ২০২২ সালের ১৯ ডিসেম্বর মামলা দায়ের করার পর ২০২৩ সালের ৩০ নভেম্বর চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। মামলা ও চার্জশিটে একমাত্র আসামি আব্দুছ ছাত্তার মিয়া। তবে, তদন্তে আমরা ওই দপ্তরের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব অবহেলার সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছি। সরকারি কোষাগারে জমার আগে এ সংক্রান্ত নথি হিসাবরক্ষক থেকে উপ-পরিচালক পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে যাচাই-বাছাই হওয়ার কথা। কিন্তু তারা সেখানে হয় সুবিধা নিয়েছেন কিংবা দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেননি। দালিলিকভাবে অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
কী ঘটেছিল: আসামি মো. আব্দুছ ছাত্তার মিয়া ক্যাশিয়ার পদে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল ঢাকায় কর্মরত ছিলেন। ওই সময়ে হাসপাতালের লিখিত নির্দেশনা অনুযায়ী অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক (রেন্ট কালেক্টর ভারপ্রাপ্ত) হাফেজ মো. আলী ইমামের নিকট হতে রোগীদের চিকিৎসাসেবা ও বিভিন্ন পরীক্ষার সরকারি রাজস্ব (ইউজার ফি) বাবদ আদায় হওয়া অর্থ রেজিস্টারে স্বাক্ষর দিয়ে গ্রহণ করতেন। আদায় করা অর্থ অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের মিটফোর্ড হাসপাতাল শাখায় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের নামে পরিচালিত হিসাবে জমা প্রদান করতেন। জমা হওয়া অর্থ উত্তোলন করে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগার তথা সোনালী ব্যাংকের মিটফোর্ড রোড শাখায় নিয়মিত জমা দিতেন ছাত্তার।
২০২২ সালের ১ থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত আদায় হওয়া ইউজার ফি হিসাবে মোট ৩০ লাখ ৭২ হাজার ৪৮ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার জন্য গ্রহণ করেন তিনি। অতঃপর মিটফোর্ড হাসপাতালের নামে পরিচালিত অগ্রণী ব্যাংকের মিটফোর্ড হাসপাতাল শাখায় ট্রেজারি চালানে চেকের মাধ্যমে ওই টাকা জমা করার জন্য ২০২২ সালের ২০ আগস্ট হিসাবরক্ষকের নিকট নথি পেশ করেন। হিসাবরক্ষক মো. জাহেদুর রহিম ওই নথি পরের দিন অর্থাৎ ২১ আগস্ট প্রধান সহকারী মো. আব্দুর রহিম ভূঁইয়ার কাছে জমা দেন। যা পর্যায়ক্রমে এসএসএমসি মিটফোর্ড হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন, ভারপ্রাপ্ত হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. জাহেদুর রহিম, সহকারী পরিচালক (অর্থ ও স্টোরস) ডা. মো. মফিজুর রহমান মোল্লা, উপ-পরিচালক ডা. মোহাম্মদ আলী হাবিব ও পরিচালক অনুমোদন করেন।
পরবর্তীতে হিসাবরক্ষক আব্দুছ ছাত্তার মিয়া নিজে সোনালী ব্যাংকের মিটফোর্ড রোড শাখায় ওই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর দুটি ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে পাঁচ লাখ ৩০ হাজার ৩৫ টাকা ও ২৪ লাখ ৭১ হাজার ৪১৩ টাকাসহ মোট ৩০ লাখ এক হাজার ৪৪৮ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেন। অর্থাৎ তিনি ৭০ হাজার ৬০০ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেননি। ওই টাকা জমা না হলেও এ বিষয়ে আসামি আব্দুছ ছাত্তার মিয়া থেকে উপ-পরিচালক ডা. মোহাম্মদ আলী হাবিব কেউই নথিতে বিষয়টি উল্লেখ করেননি কিংবা ৭০ হাজার ৬০০ টাকা কোথায় খরচ হলো কিংবা কেন জমা হয়নি— সে বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
অনুরূপভাবে ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত হাসপাতালের ইউজার ফি বাবদ পাঁচ কোটি ১৩ লাখ ৮৮ হাজার ৬৮৮ টাকা আদায় হয়। যার মধ্যে মো. আব্দুছ ছাত্তার মিয়া ২০২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত ১০টি ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা দেন দুই কোটি ৩২ লাখ ৬২ হাজার ২৯৮ টাকা এবং অপর একটি চালানের মাধ্যমে ওই বছরের ১৭ নভেম্বর এক লাখ ৪০ হাজার ৬০০ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেন। হাসপাতালে রোগীদের পরীক্ষা না হওয়ায় আদায় হওয়া অর্থ থেকে ফেরত দেওয়া হয় তিন লাখ ৮৪ হাজার ৬৯০ টাকা। সবমিলিয়ে দুই কোটি ৫৯ লাখ ৪৫ হাজার ২৪৭ টাকার হিসাব পাওয়া গেলেও বাকি দুই কোটি ৫৪ লাখ ৪৩ হাজার ৪৪১ টাকার হিসাব পাওয়া যায়নি। ওই টাকা হিসাবরক্ষক ছাত্তার হাসপাতালের ব্যাংক হিসাবে কিংবা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে একই প্রক্রিয়ায় আত্মসাৎ করেন।
এ অবস্থায় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. মোহাম্মদ আলী হাবিব, সহকারী পরিচালক ডা. মো. মফিজুর রহমান, হিসাবরক্ষক ও ভারপ্রাপ্ত হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. জাহেদুর রহিম, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন ও প্রধান সহকারী মো. আব্দুর রহিম ভূঁইয়া সকলেই ইউজার ফি সরকারি কোষাগারে জমা প্রদানের বিষয়টি যথাযথভাবে তদারকি না করে দায়িত্ব পালনে অবহেলা করার বিষয়টি তদন্তকালে প্রমাণিত হয়েছে। যা সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা- ২০১৮ এর ৩ (খ) বিধি অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’-এর শামিল। এ কারণে উক্ত কার্যকলাপের জন্য তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য দুদক থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এর আগে ২০২২ সালের ১৯ ডিসেম্বর চিকিৎসাসেবা ও বিভিন্ন পরীক্ষার আড়াই কোটি টাকা আত্মসাৎ মামলার আসামি সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হিসাবরক্ষক আব্দুছ ছাত্তার মিয়াকে গ্রেপ্তার করে দুদক। সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে দুদকের সহকারী পরিচালক মাহবুবুল আলমের নেতৃত্বে একটি টিম তাকে গ্রেপ্তার করে। তিনিই মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা। আসামির বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ৪০৯ ধারাসহ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭ এর ৫ (২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়। জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা মাহবুবুল আলম বলেন, মামলা ও চার্জশিট দাখিল করা দুদকের নিয়মিত প্রক্রিয়া। এ বিষয়ে আপনি জনসংযোগ দপ্তরে যোগাযোগ করেন।