বিশেষ চক্র পরিকল্পিতভাবে শেয়ারবাজারে দরপতনের ঘটনা ঘটাচ্ছে

মাত্র সাত কার্যদিবসে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন ৩০ হাজার কোটি টাকার ওপর নাই হয়ে গেছে। আর প্রধান মূল্যসূচক কমেছে প্রায় সাড়ে চারশ পয়েন্ট।

বিশেষ চক্র পরিকল্পিতভাবে শেয়ারবাজারে দরপতনের ঘটনা ঘটাচ্ছে

প্রথম নিউজ,ঢাকা: মাত্র সাত কার্যদিবসে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন ৩০ হাজার কোটি টাকার ওপর নাই হয়ে গেছে। আর প্রধান মূল্যসূচক কমেছে প্রায় সাড়ে চারশ পয়েন্ট। এরই মধ্যে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও সংকটকে হাতিয়ার বানিয়ে বাজারে বিভিন্ন গুজব ছড়িয়েছে চক্রটি।  রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের যে কথা বলা হচ্ছে, তা পুরোনো ইস্যু। এ কারণে আমাদের শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার কোনো কারণ নেই। তাছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশের শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। 

অভিযোগ উঠেছে, এ চক্রটিকে পেছন থেকে সহায়তা করছেন ডিএসইর কিছু কর্মকর্তা। তাদের পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই পতনের বাজারে কয়েকটি বিষয় তদন্তে নামে ডিএসই, যা শেয়ারবাজারের দরপতনকে ত্বরান্বিত করে। ফলস্বরূপ সম্প্রতি বড় পতন দেখতে হয়েছে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের। সর্বশেষ সাত কার্যদিবসের টানা দরপতনে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক কমেছে ৪৪০ পয়েন্ট। ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ৩০ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা। শেয়ারবাজারে এমন দরপতন হওয়ায় দিশেহারা সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। প্রতিদিন তারা পুঁজি হারানোর শঙ্কায় ভুগছেন।

এদিকে বাজারকে পতন থেকে বের করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন নানা চেষ্টা চালালেও তা সফলতার মুখ দেখছে না। ফলে বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট বেড়েই চলছে। এ বিষয়ে বিনিয়োগকারী মশিউর রহমান বলেন, বাজার ভালো করতে আইসিবির বিনিয়োগ বাড়ানোসহ বিএসইসি বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু তাতে তো কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। কোনো কিছুতেই কোনো কূল করতে পারছি না। এর আগে বাজার খারাপ হয়েছে, কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে আমি কখনো পড়িনি। এখন যেখানেই বিনিয়োগ করছি, সেখানেই লোকসান। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে আমাদের মতো সাধারণ বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব হয়ে যাবে।

শেয়ারবাজারে যে দরপতন চলছে তার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ আমরা দেখি না। বিশ্বের অন্যান্য দেশের শেয়ারবাজারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আমাদের এখানে সামাজিক যোগাযোগ বা বিভিন্ন কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক কাজ করছে। তবে আশা করি এটা দ্রুত কেটে যাবে এবং নতুন সপ্তাহ থেকে আমরা ভালো বাজার পাবো। 

অবশ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক পতনের বাজারে গড়পড়তা সব ধরনের কোম্পানির শেয়ার দাম কমেছে। ভালো কোম্পানিও এই পতন থেকে রক্ষা পায়নি। শেয়ারবাজারে যে দরপতন হচ্ছে তার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই। যেহেতু ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ার দাম কমে গেছে, তাই বিনিয়োগকারীদের উচিত ভালো শেয়ার বাছাই করে ক্রয় করা।

তবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বাধার পরিপ্রেক্ষিত্রে বৈশিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিলে দেশের শেয়ারবাজারে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টির পাঁয়তারায় লিপ্ত হয় সরকারবিরোধী চক্রটি। সম্প্রতি ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও সংকট দেখা দিলে তারা শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়িয়ে দেয়। সেই সঙ্গে বাজারে ছড়ানো হয় বিভিন্ন ভীতিকর তথ্য। এমনকি কোনো কোনো ব্রোকারেজ হাউজ থেকে বিনিয়োগকারীদের নতুন বিনিয়োগে নিরুৎসাহিতও করা হয়। এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে টানা দরপতনের মধ্যে পড়েছে শেয়ারবাজার।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্রোকারেজ হাউজের শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, শেয়ারবাজারে এখন যে দরপতন হচ্ছে তা অস্বাভাবিক। পরিকল্পিতভাবে কোনো বিশেষ চক্র এই দরপতন ঘটাচ্ছে। ডিএসইর যেসব সদস্য রয়েছেন তার একটি বড় অংশই সরকারবিরোধী মতাদর্শের। সরকারবিরোধী মতাদর্শের এসব ব্রোকারেজ হাউজ থেকে একদিকে শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ানো হচ্ছে, অন্যদিকে নতুন বিনিয়োগ করা হচ্ছে না। বিএসইসির উচিত কোন হাউজ থেকে অস্বাভাবিক বিক্রির চাপ বাড়ানো হচ্ছে এবং কারা নিষ্ক্রিয় তাদের খুঁজে বের করা।

তারা আরও বলেন, বাজার যখন ভালো ছিল তখন ডিএসই’র প্রশাসন অনেকটাই নিষ্ক্রিয় ছিল। কিন্তু সম্প্রতি বাজারে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দিলে হঠাৎ করেই সেনসেটিভ কিছু বিষয় নিয়ে তদন্ত শুরু করে ডিএসই, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছাড়ায়। ফলে শেয়ারবাজারের দরপতন আরও ত্বরান্বিত হয়। সরকারবিরোধী যে চক্র শেয়ারবাজারে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি করার চেষ্টা চালাচ্ছে, তাদের সঙ্গে ডিএসইর কর্মকর্তাদের কারও কারও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। মূলত তাদের দিয়েই বিভিন্ন তদন্তের নামে বাজারে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে।

এদিকে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সম্প্রতি তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এই ছয় কর্মকর্তার মধ্যে রয়েছেন- ডিএসইর মহাব্যবস্থাপক (ডিএম) মো. সামিউল ইসলাম ও মো. আসাদুর রহমান। এদের সঙ্গে আছেন উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. শফিকুর রহমান, মো. সফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া এবং সিনিয়র ম্যানেজার মো. রনি ইসলাম ও মো. পাঠান (হারুনুর রশিদ পাঠান)। এই ছয় কর্মকর্র বিরুদ্ধে তদন্ত করে ৩০ জুনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে বিএসইসি।

যোগাযোগ করা হলে শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সৃষ্টি হওয়া আতঙ্কের কারণে শেয়ারবাজারে দরপতন হচ্ছে। বাজারে ভালো-মন্দ সব ধরনের শেয়ারের দরপতন হয়েছে। অনেক ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ার যৌক্তিক মূল্যের নিচে নেমে গেছে। আমি মনে করি বিনিয়োগকারীদের উচিত এসব প্রতিষ্ঠান বাছাই করে শেয়ার কেনা। তাহলে ভালো লাভ পাওয়া যাবে।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, শেয়ারবাজারে যে দরপতন চলছে তার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ আমরা দেখি না। বিশ্বের অন্যান্য দেশের শেয়ারবাজারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আমাদের এখানে সামাজিক যোগাযোগ বা বিভিন্ন কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক কাজ করছে। তবে আশা করি এটা দ্রুত কেটে যাবে এবং নতুন সপ্তাহ থেকে আমরা ভালো বাজার পাবো।

সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে সরকারবিরোধী পক্ষ পরিকল্পিতভাবে শেয়ারবাজারে দরপতন ঘটাচ্ছে কি না? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো তথ্য আমার জানা নেই। আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, শেয়ারবাজারে এখন যে দরপতন হচ্ছে তা পরিকল্পিত। সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে, সরকারবিরোধী চক্র পরিকল্পিতভাবে এই দরপতন ঘটাচ্ছে। তাদের সঙ্গে আর একটি চক্র আছে, যারা কম দামে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার হাতিয়ে নিতে চাচ্ছে।

তিনি বলেন, অতীতেও সরকারবিরোধী চক্র শেয়ারবাজারে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়েছে। সেই চক্র এখন আবার বাজারে সক্রিয় হয়েছে। বিএসইসির উচিত এই চক্রকে চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। বিএসইসি চাইলেই সার্ভিলেন্সের মাধ্যমে খুঁজে বের করতে পারে, কারা অস্বাভাবিক শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়াচ্ছে এবং কারা নিষ্ক্রিয় রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের যে কথা বলা হচ্ছে, তা পুরোনো ইস্যু। এ কারণে আমাদের শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার কোনো কারণ নেই। তাছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশের শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং এটা স্পষ্ট সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে একটি বিশেষ চক্র পরিকল্পিতভাবে আমাদের শেয়ারবাজারে দরপতনের ঘটনা ঘটাচ্ছে।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom