বিমানবন্দরে চুরি হওয়া স্বর্ণ বিক্রি হয় তাঁতীবাজার, বায়তুল মোকাররমে
পর্যায়ক্রমে বিমানবন্দরের ভল্ট থেকে স্বর্ণ চুরির পর বিভিন্ন সময়ে ধাপে ধাপে স্বর্ণের দোকানগুলোতে বিক্রি করে চক্রের সদস্যরা।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: বিমানবন্দরের কাস্টম হাউসের ভল্ট থেকে চুরি হওয়া স্বর্ণ রাজধানীর তাঁতীবাজার এবং বায়তুল মোকাররমের বিভিন্ন জুয়েলারি দোকানসহ একাধিক স্থানে বিক্রি হয়েছে বলে জানা গেছে। স্বর্ণ চুরির সঙ্গে জড়িত কাস্টমসের ৮ কর্মকর্তা এবং সিপাহিদের সঙ্গে আগে থেকেই তাঁতীবাজার ও বায়তুল মোকাররমের কিছু অসাধু জুয়েলারি দোকান এবং অবৈধ চোরাকারবারিদের যোগাযোগ ছিল।
পর্যায়ক্রমে বিমানবন্দরের ভল্ট থেকে স্বর্ণ চুরির পর বিভিন্ন সময়ে ধাপে ধাপে স্বর্ণের দোকানগুলোতে বিক্রি করে চক্রের সদস্যরা। তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশের ঊর্ধ্বতন সূত্র জানায়, পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারের একাধিক জুয়েলারি দোকান এবং বায়তুল মোকাররমের চোরাই স্বর্ণ বেচাকেনায় জড়িত অসাধু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল চক্রের একাধিক সদস্যের। তারা হোয়াটসঅ্যাপ, সিগন্যালসহ বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করতেন।
চক্রে জড়িত সন্দেহে ৮ কাস্টমস কর্মকর্তা এবং সিপাহিদের মধ্যে অনুষ্ঠিত গোপন মিটিংয়ে তাঁতীবাজার এবং বায়তুল মোকাররমের একাধিক ক্রেতা উপস্থিত ছিলেন। তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে অভিযুক্তদের যোগাযোগ এবং গতিবিধি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তারা প্রসঙ্গ ভিন্নখাতে প্রবাহের চেষ্টা করেন। এ ছাড়াও সন্দেহভাজন দুই কাস্টমস কর্মকর্তা (সহকারী রাজস্ব) শহিদুল ইসলাম, সাইদুল ইসলাম শাহেদ শীর্ষ পর্যায়ে কাস্টমস কর্মকর্তাদের আশীর্বাদপুষ্ট এবং নিকটাত্মীয় বলে জানা গেছে।
চুরি যাওয়া স্বর্ণের বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে তারা তাঁতীবাজার এবং বায়তুল মোকাররমে জুয়েলারি দোকানে স্বর্ণের বারগুলো বিক্রি করেছেন বলে জানতে পারি। বর্তমানে এসব তথ্য সঠিক কিনা সেগুলো যাচাই-বাছাই চলছে। চুরিকৃত স্বর্ণের সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে জানতে প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন সোর্স ব্যবহার করে যে সকল স্থানে এবং যাদের কাছে স্বর্ণ বেচাকেনা করা হয়েছে তাদের বিষয়ে খোঁজখবর করা হচ্ছে। এ ছাড়া যেহেতু মামলাটির তদন্তভার বর্তমানে গোয়েন্দা উত্তরা বিভাগকে দেয়া হয়েছে তারা অবৈধ এসব স্বর্ণ ক্রেতাদের খুঁজে বের করবেন বলে জানায় সূত্রটি।
চুরির ঘটনা প্রকাশ্যে আসার আগে দফায় দফায় কাস্টমসের দুই সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম, সাইদুল ইসলাম শাহেদ ও সিপাহি নিয়ামত হাওলাদারের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তদন্ত সূত্র জানায়, চুরি হওয়া ৫৫ কেজি স্বর্ণ উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট সন্দেহভাজন কাস্টমস সদস্যদের বাসায় অভিযান পরিচালনা করা হলেও চোরাই স্বর্ণ উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। এদিকে চুরি করা স্বর্ণ কোন কোন ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করা হয়েছে তাদের শনাক্ত করে অভিযুক্ত কাস্টমস কর্মকর্তা ও সিপাহিদের মুখোমুখি করার চেষ্টা করে তদন্ত কর্মকর্তারা।
এ সময় সহকারী দুই রাজস্ব কর্মকর্তা এবং সিপাহি নিয়ামত তদন্ত কর্মকর্তাদেরকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মিথ্যা এবং ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বিমানবন্দরের মতো সুরক্ষিত একটি এলাকায় প্রায় ২৪টি নিরাপত্তা বাহিনী ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করছেন। চূড়ান্ত নিরাপত্তার বিষয়টি এপিবিএন দেখে থাকেন। কাস্টমসের এত বড় একটি চুরির ঘটনা ২৪টি নিরাপত্তা বাহিনীর নজর এড়িয়ে কীভাবে হলো সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সূত্র জানায়, ৫৫ কেজি স্বর্ণ একদিন কিংবা এক সপ্তাহের মধ্যে পাচার করা সম্ভব নয়।
দীর্ঘদিনের পরিকল্পনায় বিমানবন্দরের মতো এরকম অধিক সুরক্ষিত এলাকা থেকে স্বর্ণ চুরি ঊর্ধ্বতনদের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সিভিল এভিয়েশন, এপিবিএন, কাস্টমসসহ সংশ্লিষ্ট কেউ এই দায় এড়াতে পারেন না। কাস্টমসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একজনের আত্মীয় রয়েছেন আটককৃত ৮ জনের মধ্যে। এদের তিন জনকে জিজ্ঞাসাবাদকালে তাদের বক্তব্যে বিভিন্ন অসঙ্গতি দেখা গেছে। শহিদুল ও শাহেদ এ ঘটনায় সরাসরি জড়িত বলে জানিয়েছে পুলিশ। সিপাহি নিয়ামতসহ শহিদুল ও শাহেদ তাদের নির্ধারিত কর্মঘণ্টার বাইরে বিভিন্ন সময়ে বিমানবন্দর এলাকায় দেখা করেন। নিজেদের মধ্যে একাধিক মিটিং করেন। মুঠোফোনসহ তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাদের আন্তঃযোগাযোগের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। বিমানবন্দর থানা পুলিশ সূত্র জানায়, স্বর্ণের মতো গুরুত্বপূর্ণ ধাতব পদার্থ রাখার ভল্ট ছিল একেবারেই অরক্ষিত। সেখানে পরিচ্ছন্নতাকর্মী থেকে শুরু করে দায়িত্বরত যে কেউ চাইলেই সহজে ভেতরে প্রবেশ করতে পারতেন।
এ বিষয়ে মহানগর পুলিশের উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, তদন্তের এক পর্যায়ে আমরা খোয়া যাওয়া স্বর্ণ উদ্ধারের বিষয়ে অভিযান পরিচালনা করি। এ সময় আটককৃত এক কর্মকর্তার বাসায় স্বর্ণ রয়েছে বলে আমাদের কাছে তথ্য আসে। তার বাসায় অভিযান পরিচালনার জন্য পদক্ষেপ নেই। এ সময় জানতে পারি খোয়া যাওয়া স্বর্ণের কিছু অংশ রাজধানীর তাঁতীবাজার, পল্টন এবং বায়তুল মোকাররমে পৃথকভাবে বিক্রি করা হয়েছে।
কাদের কাছে এসব স্বর্ণ বিক্রি করা হয়েছে, ক্রেতা কারা ছিলেন এসব বিষয় যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, বিমানবন্দরে ঘটে যাওয়া এত বড় ঘটনার দায় আসলে সংশ্লিষ্ট কেউ এড়াতে পারে না। যেহেতু মামলাটি বর্তমানে মহানগর গোয়েন্দা উত্তরা বিভাগ তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছেন তারাই এ বিষয়ে শিগগিরই বিস্তারিত জানাতে পারবেন বলে জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা। এদিকে গোয়েন্দা হেফাজতে আটককৃতদেরকে আদালতে হাজির করে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডের আবেদন করা হতে পারে বলে জানিয়েছে সূত্রটি।
চুরি হওয়া স্বর্ণ কোথাও বিক্রি হয়েছে কিনা জানতে চাইলে বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আজিজুল হক মিঞা বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা স্বর্ণের সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারিনি। চুরি হওয়া স্বর্ণ যেখানেই এবং যাদের কাছে বিক্রি করা হোক না কেন তাদের প্রত্যেককেই আইনের আওতায় আনা হবে। এ বিষয়ে জানতে গোয়েন্দা উত্তরা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. আকরাম হোসেনকে ফোন দিলে মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এর আগে মঙ্গলবার রাতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কাস্টম হাউজের গুদাম থেকে ৫৫ কেজি সোনা গায়েবের মামলা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।