বিবিসির প্রতিবেদন: বিএনপি কেন ডিসেম্বরেই নির্বাচন চাইছে?

বিবিসির প্রতিবেদন: বিএনপি কেন ডিসেম্বরেই নির্বাচন চাইছে?

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে এবার কঠোর অবস্থানে গেছে। নয়াপল্টনে এক সমাবেশে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান জানিয়েছেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দিতে হবে। তাঁর বক্তব্যে আলটিমেটামের সুর স্পষ্ট ছিল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতেই বিএনপির এই বক্তব্য। প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি কেন ডিসেম্বরেই ভোট চায়? এতে তারা কতটা চাপ তৈরি করতে পারবে?

বিশ্লেষকেরা বলছেন, নির্বাচন নিয়ে চাপ বাড়াতে গিয়ে বিএনপি একা হয়ে পড়ছে কি না, তা নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছে। কারণ, বিএনপির এই অবস্থানে নেই প্রভাবশালী অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিগুলো। জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান থেকে উঠে আসা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান সরকারের নির্বাচনী সময়সূচির পক্ষে। ফলে বিএনপির এই দাবি ঘিরে তারা কোনো সংহতি দেখাচ্ছে না।

অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রতিপক্ষ বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে—এমন অভিযোগ করেছে বিএনপি। যদিও সরকারের উপদেষ্টারা এই অভিযোগ মানতে নারাজ। এ অবস্থায় ডিসেম্বরেই ভোটের জন্য বিএনপি দেশজুড়ে কর্মী ও জনসাধারণকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। দলটির নেতাদের অভিযোগ, সরকার ডিসেম্বরেই ভোট করতে চায় না। রোডম্যাপ দিতে বাধ্য না হলে সরকার তা দেবে না। ফলে সরকারকে বাধ্য করাই তাদের লক্ষ্য।

সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। তবে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাপান সফরে গিয়ে জানিয়েছেন, ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের আগের অবস্থানেই সরকার রয়েছে।

গত সপ্তাহে প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের গুঞ্জনের পটভূমিতে তিনি ২২টি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকগুলোর মাধ্যমে সংকট সাময়িকভাবে নিরসন হলেও বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারের সঙ্গে বিএনপি ও সেনাবাহিনীর দূরত্ব এখনো কাটেনি।

কেন বিএনপি এখনই নির্বাচন চায়

রাজনীতিতে একটি ব্যাপক ধারণা তৈরি হয়েছে যে, ভোট হলে বিএনপিই ক্ষমতায় আসবে। কারণ, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপি নিজেকে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখছে না। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দ্রুত ক্ষমতায় যেতে চায় দলটি।

তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিএনপির নেতা-কর্মীদের অনেকেই ইতোমধ্যে ক্ষমতা-পূর্ববর্তী আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। রাজধানী থেকে গ্রাম পর্যন্ত দখল, চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারে তারা জড়াচ্ছেন। এই অবস্থায় নির্বাচন পিছিয়ে গেলে এসব কর্মকাণ্ড বেড়ে যাবে—এই আশঙ্কা থেকে দলীয় নেতৃত্ব চায়, দ্রুত ভোট হোক।

বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব অভিযোগ করেছে, অপরাধে জড়িত নেতাকর্মীদের বরখাস্ত ও বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হলেও তা বন্ধ করা যায়নি। এতে দল সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। এই বাস্তবতায় ডিসেম্বরের পর নির্বাচন হলে দলের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়তে পারে বলে মনে করছে বিএনপি। তারা মনে করে, দেরিতে নির্বাচন হলে সমালোচনার মুখে পড়বে দলটি, যদিও ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাবে।

এনসিপি ও জামায়াতকে নিয়ে আশঙ্কা

বিএনপির দাবি, এনসিপি এবং জামায়াত সুবিধাবাদী অবস্থান নিচ্ছে। এনসিপির প্রতি প্রধান উপদেষ্টার পক্ষপাতিত্ব রয়েছে—এই অভিযোগ বিএনপির। দলটি মনে করে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন আগের সরকারের বিচার শেষ না করে এনসিপি ভোটে যেতে চায়। আর জামায়াত চাইছে রমজানের আগে-পরে নির্বাচন।

তবে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেছেন, তারা নির্বাচন চান রমজানের আগ বা পরে। এই অবস্থানকে ভিন্নভাবে দেখা অনুচিত। বিএনপি নেতারা মনে করেন, এনসিপি ও জামায়াতের সঙ্গে ইসলামপন্থি আরও কয়েকটি দলকে এককাট্টা করে বিএনপিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বানানোর চেষ্টা হচ্ছে। এটাই তাদের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব।

সরকারে থাকার লোভ?

বিএনপির মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে ক্ষমতায় থাকার লোভ তৈরি হয়েছে। সে কারণে সরকার নির্বাচন পেছাতে চায়। ঢাকায় দলের তারুণ্য সমাবেশে তারেক রহমান বলেন, “কথিত অল্প সংস্কার আর বেশি সংস্কারের অভিনব শর্তের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচনের ভবিষ্যৎ।”

তিনি আরও বলেন, “সংস্কার নিয়ে সময়ক্ষেপণের আড়ালে অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে ও বাইরে কারও কারও ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে—এমন বিশ্বাস জনগণের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে।” বিএনপি সরকারের ব্যর্থতাকেও সামনে আনছে। তাদের অভিযোগ, সরকার আইনশৃঙ্খলা ও অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ। এসব ব্যর্থতা ঢাকতে সরকার ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সামনে আনছে এবং নির্বাচন পেছাতে চাইছে।

সরকারকে কতটা চাপে ফেলতে পারবে বিএনপি?

বিএনপি মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকারের দুই বড় অংশীজন হচ্ছে তারা এবং সেনাবাহিনী। এই দুই পক্ষ সহযোগিতা না করলে সরকার চাপের মুখে পড়বে। বিএনপি এখন সরকারকে সহযোগিতা না করার ইঙ্গিতও দিচ্ছে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, তারা গণতান্ত্রিক কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে চাপে ফেলতে চান। সরকার বাধ্য না হলে রোডম্যাপ দেবে না—এটা তাদের বিশ্বাস।

সরকার অবস্থানেই অনড়

সরকারের পক্ষ থেকে এখনো ডিসেম্বরের নির্বাচনের কোনো ইঙ্গিত নেই। প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, বর্তমান সরকার আগামী বছরের ৩০ জুনের পর একদিনও ক্ষমতায় থাকবে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার—ডিসেম্বরে নির্বাচন চায় না সরকার।

বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, সরকার সংস্কারের জন্য সময় চায় বলেই জুন পর্যন্ত সময় নিচ্ছে। তবে গত ৯ মাসেও কোনো সংস্কার হয়নি, নির্বাচনের নির্দিষ্ট সময়ও জানানো হয়নি। ফলে সরকার ও অন্য অংশীজনদের মধ্যে দূরত্ব কমেনি।

উপদেষ্টার পদত্যাগের ভাবনার পটভূমি

২২ মে থেকে প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের গুঞ্জন ছড়ায়। এর আগেই বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা না করার প্রতিবাদে রাস্তায় অবস্থান নেয়। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যেই হওয়া উচিত।

এই অবস্থায় এনসিপি নেতা নাহিদ ইসলামকে ডেকে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর পদত্যাগের ভাবনার কথা বলেন। এরপর উত্তেজনা তৈরি হলে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন তিনি। উপদেষ্টা পরিষদের বিবৃতিতে বলা হয়, “পরাজিত শক্তির ইন্ধনে ও বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সরকারের ওপর দায়িত্ব পালন অসম্ভব হলে, সব কারণ জনসমক্ষে তুলে ধরা হবে।”

বিবৃতির ভাষা দেখে অনেকেই মনে করছেন, এতে সরকার বিএনপি ও সেনাবাহিনীকে হুমকি দিয়েছে। বিএনপিও বিষয়টি একইভাবে দেখছে।

উপদেষ্টাকে বৈঠকে রাখা নিয়ে বিতর্ক

বিএনপি উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের পদত্যাগ দাবি করলেও তাঁকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে রাখা হয়। এতে বিএনপির মধ্যে সরকারের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস বেড়েছে। তারা মনে করছে, সরকার বিএনপির দাবিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। এই অবস্থানকে বিএনপি ‘ঔদ্ধত্য’ হিসেবে দেখছে।

নিয়ন্ত্রণহীনতা ও বিতর্ক

রাখাইনের জন্য মানবিক করিডর, সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ সংশোধনসহ নানা বিষয়ে সরকার বিতর্কে জড়িয়েছে। সচিবালয়ে আন্দোলন চলছে কর্মকর্তাদের। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা ও উত্তেজনা নতুন করে বাড়ছে। যদিও আপাতত পরিস্থিতি শান্ত, কিন্তু পর্দার আড়ালে সংকট প্রকট।