বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নের প্রয়োজন আছে কি?

 বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নের প্রয়োজন আছে কি?

প্রথম নিউজ, ঢাকা : সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি অপসারণে সংবিধান সংশোধন এবং আইন তৈরি পর্যন্ত গড়ালেও বিচারক নিয়োগের কোনো আইন নেই। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ও সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও স্বাধীনতার এত বছরেও আলোর মুখ দেখেনি বিচারক নিয়োগ আইন। যদিও ২০১২ সালে আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। এরপর একযুগ কেটে গেলেও খসড়ায় আটকে আছে আইনটি। এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার আশ্বাস দেওয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে বিচারক নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। এক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির পরামর্শ নেওয়ার প্রথা রয়েছে। এ ব্যাপারে নীতিমালা করতে উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা এবং আইন কমিশনের সুপারিশ থাকলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি।

আইনজীবীরা বলছেন, নির্দলীয় ও দক্ষ বিচারক নিয়োগের মাধ্যমে শক্তিশালী বিচার বিভাগ গড়ে তুলতে বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য আইন প্রণয়ন না করে বিচারক নিয়োগের ফলে স্বচ্ছতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যে প্রশ্ন উঠছে, তা থেকেই যাবে। তাদের অভিমত, যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে বাছাই করার স্বার্থে বিচারপতি নিয়োগে আইন করা জরুরি হলেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার পর থেকে সব সরকারই তা উপেক্ষা করেছে।

    ‘বিচারপতি নিয়োগ এখন আর আগের মতো নয়। সরকারও ইচ্ছে মতো করতে পারবে না। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বরাবর পাঠাবেন। বিচারক নিয়োগ আইন প্রণয়ন খুব বেশি প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।’— অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিন

এক্ষেত্রে পরামর্শের ব্যতিক্রম হয়েছে বলে বিভিন্ন সময়ে শোনা যায়। হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে যোগ্য লোক খুঁজে পেতে বিভিন্ন মাপকাঠির কথা রায়ে বলা হয়েছে। যেহেতু পুরো প্রক্রিয়া রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান বিচারপতি সম্পন্ন করেন, তাই আদেশ জারি করেননি। নীতিমালা তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথাও এ রায়ে বলা হয়েছে। নীতিমালা তৈরি সংসদের সার্বভৌম এখতিয়ার হওয়ায়- আদালত সেখানেও কোনো নির্দেশনা দেননি।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘সংবিধানের নির্দেশনা আছে বিচারপতি নিয়োগে নীতিমালা প্রণয়ন করার এবং এটা রিফর্ম করা হয়েছে আমাদের দশ বিচারপতির মামলার রায়ে। সেই মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট এবং হাইকোর্টের কতগুলো নীতিমালা সুস্পষ্টভাবে আমরা পেয়েছি। উচ্চ আদালত সংবিধানের আলোকে রুলস তৈরির জন্য বলেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যারা ক্ষমতায় আছেন, সুপ্রিম কোর্টের এ নির্দেশনা এখন পর্যন্ত কার্যকর করেননি। কিন্তু যেভাবে বিচারক নিয়োগ হচ্ছে এ পুরোনো আমলের চিন্তা-চেতনার মধ্য দিয়ে, আমরা সেভাবে সৎ, যোগ্য ও মেধাবী বিচারক পাচ্ছি না।’

‘সবচেয়ে বড় কথা হলো, সুস্পষ্টভাবে রুলস না থাকায় যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে অনেক অপব্যবহার করা হয়। সরকারের আইনজীবী বা জ্যেষ্ঠ বিচারক থেকে (হাইকোর্টে) বিচারক নিয়োগের যে প্রক্রিয়া বা প্রথা, সেটাও অনেকাংশে একের পর এক লঙ্ঘন করা হচ্ছে। ইদানীং আরও একটা বিষয়ে খুবই শঙ্কিত যে দীর্ঘদিন ধরে আইনজীবী এবং সিনিয়র বিচারকদের থেকে যে বিচারপতি নিয়োগ হতো তা ছিল দুই অনুপাত এক। অর্থাৎ দুজন আইনজীবী নিলে একজন বিচারক থেকে নেওয়া হতো। সেটাও এখন লঙ্ঘিত হচ্ছে। সুস্পষ্টভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে নিম্ন আদালত থেকে যেখানে জ্যেষ্ঠ বিচারকদের আসার কথা, তাদের না নিয়ে অনেক নিচে থেকে নিয়ম লঙ্ঘন করে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে বিচারক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু হাইকোর্ট নয়, সুপ্রিম কোর্টেও নানাভাবে লক্ষ্য করছি জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করা হচ্ছে।’

অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী আরও বলেন, ‘কয়েক বছর পরপরই আইনমন্ত্রীর মুখ থেকে শুনি যে তারা এটা (নীতিমালা) করে ফেলবেন। চলতি বছরও তিনি বলেন, সরকারের এ মেয়াদে তারা আইনটা প্রণয়ন করবেন। বাস্তবে যদি এর প্রতিফলন দেখতে পাই তাহলে মনে করি এটা সুফল বয়ে আনবে।’

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিচার বিভাগকে সংবিধানের অভিভাবক বলা হয়। যে সংবিধানের অভিভাবক হবেন, সেখানে নিয়োগের প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছ হতে হবে। সেজন্যই সংবিধান প্রণেতারা সংবিধানে একটি বিধান রেখেছেন, বিচার বিভাগ থাকবে স্বাধীন এবং স্বাধীন বিচারব্যবস্থায় বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া একটা নীতিমালার আওতায় হবে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও কোনো সরকারই সেটি করেনি। অর্থাৎ দেশের উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে আইন ও নীতিমালা কোনোটিই করা হয়নি। সব সরকারই নিজেদের ইচ্ছা চরিতার্থ করতে সংবিধানে একটি বিধান থাকা সত্ত্বেও বিচারক নিয়োগের কোনো আইন প্রণয়ন করেনি। স্বাধীন বিচারব্যবস্থার জন্য একটি আইন অবশ্যই দরকার।’

    ‘বিচারপতি নিয়োগে আইন প্রণয়নের দাবি ছিল সবারই। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, দলীয়ভাবে বিচারক নিয়োগ করা হবে না। নীতিমালা দরকার। আইনজীবী সমাজসহ আমরাও দাবি জানিয়েছিলাম, কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন হয়নি।’— সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন

‘যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে, তখন তার ইচ্ছামতো বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়। আমরা বহুবার বলেছি, বিশেষত আমি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির প্রেসিডেন্ট (সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি) থাকাকালে, আমার আগের প্রেসিডেন্টরাও বিচারপতি নিয়োগে আইন করার কথা বলেন। প্রধান বিচারপতিরাও সেটি বলছেন। দেশের মানুষও তা চায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আইনটি আজ পর্যন্ত হয়নি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আমরা শুনে আসছি বিচারক নিয়োগের আইন হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিচারক নিয়োগের কোনো আইন তো দূরে থাক, বিষয়টি সংসদে উপস্থাপন করা হবে বললেও সেটা হয়নি।’ বলেন অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান আইন কর্মকর্তা ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট মো. খুরশীদ আলম খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিচারক নিয়োগে অবশ্যই মেধাবী, সৎ এবং যোগ্যতাসম্পন্নদের নিয়োগ করা এবং আইন করা প্রয়োজন বলে মনে করি।’

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি নিয়োগে আইন প্রণয়নের দাবি ছিল সবারই। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, দলীয়ভাবে বিচারক নিয়োগ করা হবে না। নীতিমালা দরকার। আইনজীবী সমাজসহ আমরাও দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন হয়নি।’

মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, আইনমন্ত্রী বলেন, বিচারক নিয়োগের নীতিমালার খসড়া হয়েছে। তারপরও কিন্তু নীতিমালা আলোর মুখ দেখেনি। দেশবাসী কাদের বিচারক হিসেবে চায়? যারা মেধাসম্পন্ন, সৎ ব্যক্তি এবং বিতর্কের ঊর্ধ্বে তাদের। তাই এটি আলোর মুখ দেখেনি।

‘আপনারা দেখেন বিচারিক (নিম্ন) আদালতে, থার্ড ক্লাস পেলে সহকারী জজ হিসেবে আবেদন করতে পারবেন না। উনারা ২০ থেকে ২৫ বছর নিম্ন আদালতের বিচারক হিসেবে কাজ করার পর উচ্চ আদালতে বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। আর বিচারিক (নিম্ন) আদালতের আপিল রিভিশন সব কিছু শুনতে হয় উচ্চ আদালত হাইকোর্টকে। হাইকোর্টে কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দল করলেই, দলীয় আনুগত্য থাকলেই বিচারপতি হতে পারে সব সরকারের আমলেই’ অভিযোগ করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি।

সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘নতুন করে বিচারক নিয়োগের আগে অনতিবিলম্বে বিচারপতি নিয়োগ নীতিমালা প্রণয়ন করেন, আইন করেন। আমি মনে করি দলীয় এবং অযোগ্য লোক নিয়োগ করার ইচ্ছা থাকলে সরকার আইন করবে না। আর যদি সত্যিকার অর্থে সরকার ভালো বিচারক চায় এবং ন্যায়বিচার চায়, অবশ্যই বিচারক নিয়োগ নীতিমালা করবে এবং স্বচ্ছতা থাকা উচিত।’

উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনও। ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিদায়বেলায় তিনি বলেন, সংবিধানের আলোকে বিচারপতি নিয়োগ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা বাস্তবতার নিরিখে অপরিহার্য। এতে বিচারপতি নিয়োগের কাজটি আরও স্বচ্ছ ও দ্রুততর হবে এবং জনগণের মধ্যে বিচারপতি নিয়োগের স্বচ্ছতা সম্পর্কে ভিত্তিহীন ধারণা দূরীভূত হবে।বিচারক নিয়োগ নিয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিন বলেন, ‘সর্বোচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে যে জাজমেন্ট দিয়েছে তাতে মোটামুটি আইনের মতোই করে নিয়েছে। সর্বশেষ জাস্টিস এ বি এম আলতাফ হোসেনের যে জাজমেন্টটি (রায়) এসেছে, যেটি প্রধান বিচারপতি (চিফ জাস্টিস) আরও দুজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর তালিকা দেবেন। সেই তালিকা অনুযায়ী সরকার ইনটেলিজেন্ট দেখবে, দেখে বিচারক নিয়োগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। সেই তালিকা দেখে বিচারক নিয়োগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।’

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘তার মানে এখন আর আগের মতো নয়। এখন সরকারও ইচ্ছে মতো করতে পারবে না। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে ওনার পরামর্শ অনুযায়ী মহামান্য রাষ্ট্রপতি বরাবরে পাঠাবেন। বিচারক নিয়োগ আইন প্রণয়ন খুব বেশি প্রয়োজন নেই বলে আমি মনে করি।’

বিচারক নিয়োগ আইনের প্রয়োজনীয়তা আছে কি নেই তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার মনে হয় প্রয়োজন নেই। আইন প্রণয়ন করলেই সেটা একেবারে ধোয়া তুলসি পাতা হবে বিষয়টি এমন নয়। অতীতে অনেক আইন প্রণয়ন করে সেটিতে কোনো কাজ হয়নি।’

জানা যায়, ২০০৩ সালের ২৬ জুলাই ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ সভাপতি এবং সাবেক বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. মাহবুব আলী সম্পাদক থাকাকালীন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবীদের সভায় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে একটি রেজুলেশন হয়। সেখানে সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগে রাজনৈতিক যোগ্যতা বিবেচনা না করে দক্ষতার ওপর জোর দেওয়া হয়। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট সমিতির তৎকালীন সভাপতি ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম একই সিদ্ধান্তের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তখনকার প্রধান বিচারপতির কাছে প্রার্থনা জানিয়েছিলেন।

এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট এম মাহবুব আলী বলেন, ‘ঘটনা সত্য। সম্পাদক থাকা অবস্থায় আমরা সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারক নিয়োগের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবীদের সভায় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি একটি রেজুলেশন করেছিলাম। ওই সময় বিএনপি সরকারের কারণে এ উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি।’

উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ আইন প্রণয়ন নিয়ে গত ২২ ফেব্রুয়ারি সংসদে কথা বলেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। ওইদিন সংসদে এক সংসদ সদস্যের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, বিচারপতি নিয়োগের জন্য সংবিধানে একটি আইন করার কথা বলা আছে। এ সংসদে বিচারপতি নিয়োগ আইন নিয়ে আসবো।

বিচারক নিয়ে যা আছে সংবিধানে
সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে বিচারক নিয়োগ বিষয়ে বলা আছে। অনুচ্ছেদের ৯৫ (১) এ বলা হয়েছে, ‘প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারপতিকে নিয়োগদান করবেন।’

৯৫ (২) এ বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক না হলে এবং (ক) সুপ্রিম কোর্টে ন্যূনতম ১০ বছরের অ্যাডভোকেট না হয়ে থাকলে, বা (খ) বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে ন্যূনতম ১০ বছর কোনো বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠান না করে থাকলে, অথবা (গ) সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ লাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা না থাকলে, তিনি বিচারপতি পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না।’২০০৯ সালের ২ মার্চ বিচারক নিয়োগ নিয়ে এক রায় দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ। সেই রায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে বাদ পড়া ১০ বিচারপতিকে স্থায়ী নিয়োগের ক্ষেত্রে পাঁচ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেই নির্দেশনায় বিচারক নিয়োগের আইন বা নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলা হয়।

এছাড়া ২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগ উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে সাত দফা নির্দেশনা দেয়। তৎকালীন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান (বর্তমান প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের (অবসরপ্রাপ্ত) হাইকোর্ট বেঞ্চ পর্যবেক্ষণও দেয়।

সেই পর্যবেক্ষণে বলা হয়, প্রধান বিচারপতিকেই উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। তাকে প্রয়োজনে বিচারক নিয়োগের জন্য আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের দুজন করে জ্যেষ্ঠ বিচারকের পরামর্শ নিতে হবে। তবে বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতি যে মতামত দেবেন, তা অগ্রাহ্য করা যাবে না, যদি না সুপারিশ করা ব্যক্তি রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজে সম্পৃক্ত থাকেন।

ভারতের আইন কমিশনের ৮০তম প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী একজন বিচারকের পরিপক্বতা পেশাগত অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে একটি বয়সসীমা ধরা হয়েছে। সেই হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক মনোনয়নের ক্ষেত্রে বয়স সর্বনিম্ন ৪৫ বছর হওয়া উচিত বলেও পর্যবেক্ষণ দেন হাইকোর্ট বিভাগ।

অবসরজনিত কারণে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে বর্তমানে বিচারক সংকট রয়েছে। সম্প্রতি তিনজন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার পরও আপিল বিভাগে এখন বিচারকের সংখ্যা আটজন। এর মধ্যে একজন বিচারপতি এক মাসের মধ্যেই অবসরে যাবেন। থাকবেন বাকি সাত বিচারপতি।

হাইকোর্ট বিভাগ থেকে গত ১২ জুন অবসরে গেছেন একজন বিচারক (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান), হাইকোর্ট বিভাগে ৮৪ জন বিচারপতির মধ্যে ৮০ জন বিচারিককাজে যুক্ত রয়েছেন, যা মামলার তুলনায় অপ্রতুল। বিচারক সংকটের বিষয়টি প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের সাম্প্রতিক এক বক্তব্যেও ফুটে উঠেছে।

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘দেশের মাত্র দুই হাজার বিচারক ৪০ লাখেরও অধিক মামলা নিষ্পত্তির কঠিন দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করছেন। তবুও মামলাজট থেকে আমরা পরিত্রাণ পাচ্ছি না। অনেক ক্ষেত্রেই একটি মামলা নিষ্পত্তি হতে ১০ থেকে ১২ বছর লেগে যায়।’

বিশাল এ মামলাজট কমাতে উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগের কথা উঠছে। আর বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি এলেই বিচারক নিয়োগের আইন প্রণয়নের দাবিও জোরালো হয়।