ফুটবল নিয়ে আনন্দে ভাসছে মরক্কো

ফুটবল নিয়ে আনন্দে ভাসছে মরক্কো
ফুটবলে নয়া উন্মাদনা মরক্কোয়

প্রথম নিউজ, স্পোর্টস ডেস্ক: মরক্কোর এমন ভৌগোলিক অবস্থান। একই দেশের দুই প্রান্তে পৃথক দুই সাগর ও মহাসাগর! উত্তরে ভূমধ্যসাগর। পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর। উত্তর আফ্রিকার ‘মাগরেব’ অঞ্চলের ছোট দেশ মরক্কোর পূর্ব দিকে এটলাস পর্বতমালা। অদম্য চেতনার জন্য দেশটির জাতীয় ফুটবল দলকে ডাকা হয় ‘এটলাস লায়ন্স’। বিশ্বকাপ খেলেছে ছয়বার। ফুটবলের মহামঞ্চে আফ্রিকানদের নতুন ইতিহাস রচিত হয়েছিল এই মরক্কানদের ছোঁয়াতেই। সেটা ১৯৮৬ সালের কথা।  গ্রুপ পর্বে দাপুটে ফুটবল খেলে তারা ৩-১ গোলে হারায় ইউরোপিয়ান জায়ান্ট পর্তুগালকে। বিশ্বকাপে প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে গ্রুপ সেরার মর্যাদা পায় মরক্কো। তখন মোহাম্মদ তিমুমি, আবদুর রাজ্জাক খায়েরিরা চমকে দিয়েছিলেন পরাশক্তি জার্মানদেরও। শেষ ষোলোতে খেলা শেষের ২ মিনিট আগে লোথার ম্যাথিউসের এক দূরপাল্লার বুলেট ফ্রিকিকে জয়সূচক গোল পেয়েছিল পশ্চিম জার্মানি। ‘স্বপ্ন দেখা যায় বিনামূল্যেই কিন্তু তা বাস্তবায়ন করতে পারাটা ভিন্ন কথা।’ এবার রূপকথা রচনা করেছেন রোমান সাইসরা। ফুটবল বিশ্বে আফ্রিকান ও আরবদের মাথা এখন উঁচুতে। কাতার বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে গতবারের ফাইনালিস্ট ক্রোয়েশিয়ার কাছ থেকে পয়েন্ট ছিনিয়ে নেয় মরক্কো। পরে দলটির কোচ ওয়ারদি রেগরাগি বলেন, ‘বিশ্বকাপে আফ্রিকার ১০ দল থাকলে পাঁচটিই কোয়ার্টার ফাইনালে খেলতো।’ তার কথা শুনে তখন হয়তো অনেকেই ভ্রু কুঁচকেছেন। তবে এখন চিত্র ভিন্ন।

কাতার বিশ্বকাপে মরক্কোর গড়া কীর্তিতে ‘আন্ডারডগ’ শব্দটার নতুন অর্থ খুঁজছে ফুটবলবিশ্ব। প্রত্যেক বিশ্বকাপেই আফ্রিকা মহাদেশের দলগুলো ‘আন্ডারডগ’ তকমা নিয়ে খেলতে নামে। আন্ডারডগ, যার অর্থ বড় আশা নিয়ে বিশ্বকাপে গিয়ে মাঝে মাঝে সাহসী কিছু ম্যাচ খেলা। ফুটবলের বোদ্ধা বিশ্লেষকদের চিন্তায় এবারও ছিল তেমন কিছুই। কিন্তু ‘এটলাস লায়ন্স’ খ্যাত মরোক্কানদের ভাবনা ছিল ভিন্ন। ফুটবলের ৯২ বছরের বিশ্বকাপ ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সেমিফাইনালে খেলছে আফ্রিকা মহাদেশের কোনো দেশ। আর ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার (কনমেবল) বাইরের মাত্র তৃতীয় দেশ। ১৯৩০ বিশ্বকাপে যুক্তরাষ্ট্র ও ২০০২’র সেমিফাইনালে খেলেছিল এশিয়ার দল দক্ষিণ কোরিয়া। 

২০১০ বিশ্বকাপে নন্দিত কলম্বিয়ান শিল্পী শাকিরা গেয়েছিলেন ‘দিস টাইম ফর আফ্রিকা’। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে সেই বিশ্বকাপে আফ্রিকা মহাদেশের অগ্রযাত্রা থেমেছিল অপ্রত্যাশিতভাবে। কোয়ার্টার ফাইনালে ঘানার নিশ্চিত গোল হাত দিয়ে ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন উরুগুইয়ান স্ট্রাইকার লুইস সুয়ারেজ। এ ঘটনায় সুয়ারেজ লাল কার্ড খেলেও পেনাল্টি মিস করে পরে টাইব্রেকারে সর্বনাশ হয় ঘানার।  আফ্রিকায় হওয়া প্রথম বিশ্বকাপেও তাই কোয়ার্টার ফাইনালের বেশি যাওয়া হয়নি আফ্রিকান কোনো দেশের। ২০০২ সালে সেনেগাল থেমেছিল অতিরক্ষণাত্মক দল তুরস্কের অতিরিক্ত সময়ের এক গোলে। আর ৩২ বছর আগে ক্যামেরুনকে থামিয়ে দিয়েছিল ইংলিশ স্ট্রাইকার গ্যারি লিনেকারের পেনাল্টি শট। তিনবারই ম্যাচ গড়িয়েছিল অতিরিক্ত সময়ে। তবে এবার সব হিসাব বদলে দিয়েছে মরোক্কানরা। শেষ ষোলো, কোয়ার্টার ফাইনাল পেরিয়ে কাতার বিশ্বকাপে এখন শেষ চারের লড়াইয়ের অপেক্ষা। সেই চার দলের একটি মরক্কো। বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওঠা প্রথম আফ্রিকান দেশ, প্রথম আরব দেশ।

ইতিহাস গড়ার পথে মরক্কো গ্রুপে হারিয়েছে বেলজিয়ামের সোনালি প্রজন্মকে। শেষ ষোলো থেকে বিদায় করেছে সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন স্পেনকে। আর কোয়ার্টার ফাইনালে কাঁদিয়েছে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ও তার দল পর্তুগালকে। বিশ্বকাপ শুরুর আগে ইউরোপের এই তিন ফুটবল পরাশক্তিও ছিল শিরোপার অন্যতম দাবিদার। আর সেমিফাইনালের পথে মরক্কোর আলাদা কৃতিত্ব। বিশ্বকাপের ৫ ম্যাচে এখন পর্যন্ত মরক্কোর জালে প্রতিপক্ষের কোনো খেলোয়াড় বল পাঠাতে পারেননি। এই ৫ ম্যাচে একটাই গোল খেয়েছে মরক্কো, সেটা আত্মঘাতী। কাতার বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার প্রায় তিন মাস আগে বসনিয়ান কোচ ভাহিদ হালিলহজিচকে ছাঁটাই করে মরক্কো। এই কোচের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় জাতীয় দল থেকে বের হয়ে যান চেলসি তারকা হাকিম জিয়েশ ও বায়ার্ন মিউনিখ ডিফেন্ডার নুসাইর মাজরাবি । পরে মরক্কো দলের দায়িত্ব দেয়া হয় আফ্রিকার চ্যাম্পিয়নস লীগজয়ী কোচ ওয়ালিদ রেগরাগিকে। দলের ফিরে আসেন জিয়েশ ও মাজরাবি।  বিশ্বকাপ শুরুর আগে রেগরাগি সতর্ক করেছিলেন ভক্ত-সমর্থকদের। বলেছিলেন, ‘এই দলের কাছে খুব বেশি প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না।’ 

আর কাতারে ইতিহাস গড়ার পর মরক্কোর কোচ বলেন, ‘আমরা আসলেই এখন সবার ভালোবাসার দল হয়ে উঠছি। কারণ, আমরা দেখিয়েছি বিশ্বমানের প্রতিভা, দলের গভীরতা ও অঢেল টাকা ছাড়াও সফল হওয়া যায়, যদি প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রম থাকে।’ অধিনায়ক এবং ইংলিশ ক্লাব উলভারহ্যাম্পটনের সাবেক ডিফেন্ডার রোমান সাইস বলেছিলেন শেষ ষোল তাদের টার্গেট। আর কাতারে একের এক ধাপ টপকে মরোক্কানদের স্বপ্ন ও লক্ষ্য পর্বত প্রমাণ। অ্যাটলাস লায়ন্স অধিনায়ক রোমান সাইস বলেছেন, ‘আমরা ইতিহাস জারি রাখতে চাই।’ পর্তুগালে বিপক্ষে ম্যাচের ৫৭তম মিনিটে চোট নিয়ে মাঠ ছাড়েন সাইস। ফ্রান্সের বিপক্ষে সেমিফাইনালে খেলতে পারবেন কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেছেন, ‘মনে হয় খেলতে পারবো। তবে জোর করে খেলে দলকে বিপদে ফেলবো না।’

রোমান সাইস উঠে যাওয়া চাপ বেড়ে যায় মরক্কোর ডিফেন্সে। দারুণ নৈপুণ্য দেখানো মিডফিল্ডার সুফিয়ান আমরাবাত ওই সময় নিয়ে বলেন, ‘আমরা খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু এটা বিশ্বকাপ, অবশ্যই আপনার সবটা দিতে হবে। শেষ বাশি না বাজা পর্যন্ত দৌড়াও। আমরা দলের সবাই যেভাবে রক্ষণ করি সেটা আমাদের লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা।’ বিশ্বকাপে আর দুই ম্যাচ জিতলেই এটলাসের চূড়ায় উঠে যাবে মরক্কোর ফুটবল। আর মরক্কানদের স্বপ্নটাও এখন পর্বত-সমান। তাহলে কি শিরোপা জয়ের কথা ভাবছে মরক্কো? আমরাবাতের তাৎক্ষণিক জবাব, ‘হ্যা, কেন নয়?’

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom