নির্বাচনের সময় বাংলাদেশে যে তিনটি দৃশ্যপট তৈরি হতে পারে: দ্য ডিপ্লোম্যাট
দ্য ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়া স্টাডিজের অধ্যাপক আরিল্ড এঙ্গেলসেন রুডের লেখা থেকে অনূদিত
প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: বাংলাদেশ একটি উত্তাল নির্বাচনী মৌসুমের দিকে যাচ্ছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের কথা রয়েছে। এর আগে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া নির্বাচনগুলো ছিল বিতর্কিত। এখন আসন্ন নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশিদের পাশাপাশি এর বিদেশি মিত্ররাও পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং সামনে কী হতে পারে তা অনুমান করার চেষ্টা করছে।
এই নিবন্ধে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কিত চারটি মৌলিক বিষয়ের উপর ভিত্তি করে তিনটি দৃশ্যকল্প উপস্থাপন করা হবে। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে, বাংলাদেশে একটি নির্বাচন হবে। কারণ এটা সংবিধানে লেখা আছে এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিজেদেরকে সাংবিধানিক শৃঙ্খলার ধারক এবং দেশের গণতান্ত্রিক পরিচয়পত্রের গ্যারান্টার হিসেবে দাবি করে। এটা আওয়ামী লীগের অন্যতম শক্তি, কিন্তু দুর্বলতাও বটে। দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভোট আওয়ামী লীগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এই শ্রেণির কাছে গণতন্ত্র তাদের জাতীয়তাবাদী পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাই যথাসময়েই বাংলাদেশে নির্বাচন হবে।
দ্বিতীয়ত: এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতবে। এর পেছনে দু’টি কারণ আছে। প্রথমত- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন অত্যন্ত দক্ষ রাজনৈতিক খেলোয়াড় এবং তিনি সশস্ত্র বাহিনী, নিরাপত্তা সংস্থা, আদালত, প্রশাসন, মিডিয়া এবং ব্যবসায়ী শ্রেণিকে নিয়ে একটি শক্তিশালী জোট গঠন করেছেন। এই জোট (বৃহত্তর অর্থে একটি ক্ষমতাসীন জোট) দেশের প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)কে সরকারি দায়িত্বে স্বাগত জানাতে তারা অনিচ্ছুক। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বেশ কিছুদিন আগে পর্যন্ত বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নমূলক কাজ বেশ ইতিবাচক ছিল। বাংলাদেশের শাসকদের নিয়ে অনেক সমালোচনাই করা যেতে পারে, কিন্তু তারা উন্নয়নের নির্দিষ্ট রূপ তৈরিতে তুলনামূলকভাবে অধিক দক্ষ। অনেকেই এ কারণে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে আবারও ক্ষমতায় দেখতে চান।
আওয়ামী লীগ জিতবে বলে মনে করার দ্বিতীয় কারণ হলো, সরকার পরিবর্তন হলে ক্ষমতাসীন দল এবং ক্ষমতাসীন জোটের অনেককে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে এবং সেই পরিস্থিতি ঠেকাতে তারা যা করা দরকার তা করবে। বছরের পর বছর ধরে অনেকেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। তারা ধনী হয়েছেন কিন্তু একইসঙ্গে তাদের ঝুঁকিও বেড়েছে। পুলিশ, আদালত এবং প্রশাসনের ব্যক্তিরা একইভাবে নিজেদেরকে সিস্টেমের অংশীদার বানিয়ে ফেলেছেন। তারা বিরোধীদের হুমকি দিয়ে আসছেন, কারারুদ্ধ করে আসছেন, হয়রানি করে আসছেন, তাদের ব্যবসা বা সম্পদ দখল করেছেন এবং শাসন ব্যবস্থার অংশ হওয়ার কারণে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন। মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত দেশের সব স্তরেই এই ধরনের লোক রয়েছেন। নির্বাচনে পরাজয় হলে তারা প্রতিশোধের শিকার হবেন এবং তারা ভয়ানকভাবে আক্রান্ত হবেন। এককথায়, তাদের হারার কোনো সুযোগ নেই।
আর তৃতীয় কারণটি হচ্ছে, আওয়ামী লীগের শক্তিশালী বন্ধু রয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে প্রভাবশালী জোট গঠনে শেখ হাসিনার যে দক্ষতা রয়েছে, তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দেখা যায়। ভারত, চীন, রাশিয়াসহ আরও কিছু দেশ রয়েছে, যারা দেশে স্থিতিশীলতা থাকলে নির্বাচনী অনিয়ম নিয়ে তেমন উদ্বেগ দেখাবে না। যদিও ইইউ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিরক্ত হবে। তবে তাদের অন্যান্য উদ্বেগও রয়েছে, জাতীয়তাবাদী অনুভূতিতে এর খুব বেশি প্রভাব পড়বে না।
তৃতীয় মৌলিক বিষয় হলো, বর্তমান সরকারের অধীনে যে কোনো নির্বাচন বিএনপি বয়কট করবে। দলটি বারবার বলেছে, আগের দু’টি নির্বাচন থেকে তারা যে যন্ত্রণাদায়ক শিক্ষা পেয়েছে তাতে এই সরকারকে তারা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারবে না। চতুর্থ মৌলিক বিষয় হলো, সম্পূর্ণ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি জিতবে। এর কারণ এই নয় যে, বিএনপি বিশেষভাবে যোগ্য লোক নিয়ে গঠিত কোনো দল। এমনকি সাধারণ ভোটারদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এমন মূল্যবোধ ও ধারণার প্রতিনিধিত্বও তারা করে না। কিন্তু বাংলাদেশে মূলত দু’টি রাজনৈতিক দল রয়েছে- আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। আর অনেক ভোটার ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতার শক্তি, অহঙ্কার ও দুর্নীতি দেখে দেখে ক্লান্ত। তাদের কাছে একমাত্র বিকল্প বিএনপি।
দৃশ্যকল্প এক: ক্রমবর্ধমান সহিংসতা
২০১৪ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে বিএনপি রাজপথে জড়ো হওয়ার জন্য তার প্রচেষ্টা দ্বিগুণ করবে। সম্ভবত জামায়াতে ইসলামী এবং অন্যান্য ইসলামপন্থিদের সঙ্গে তারা জোটবদ্ধ হবে। এই দলগুলোও আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে আরও একবার ক্ষমতা দেখতে চায় না। কিন্তু এত প্রচেষ্টা এবং কঠোর বিক্ষোভ সত্ত্বেও তারা যদি নির্বাচনে হেরে যায় তাহলে তারা সহিংস হয়ে উঠতে পারে।
রাজপথে বিএনপি নেতাকর্মীদের পুলিশকে মোকাবিলা করতে হবে। ফলে তাদের কারারুদ্ধ করা হবে এবং তারা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তা সংস্থা, আদালত এবং প্রশাসন দ্বারা হয়রানির শিকার হবে। এমনকি স্কুল কর্তৃপক্ষও শিক্ষক বা ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিএনপি সমর্থনকারীদের হয়রানি করতে পারে। তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং পারমিট প্রত্যাহার করা হতে পারে।
শেষ পর্যন্ত বিএনপি’র অংশগ্রহণ ছাড়াই নির্বাচন হলে দলটি আরও বহুদিন ক্ষমতার বাইরে থেকে যাবে। ফলে এই নির্বাচনের আগে ও পরে প্রচুর বিক্ষোভ হবে। অ্যাক্টিভিস্টরা বাস পোড়ানো, দৈনন্দিন জীবনকে ব্যাহত করা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হাতে তৈরি বোমা ও ইট নিক্ষেপের পথে হাঁটবে। আওয়ামী লীগ কর্মীরাও লাঠি ও বন্দুক নিয়ে রাস্তায় তাদের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে। তবে ব্যাপক প্রতিবাদ সত্ত্বেও ক্ষমতাসীনরাই এতে জয়ী হবে।
দৃশ্যকল্প দুই: অর্থনৈতিক দুর্ভোগ
অর্থনৈতিক দুর্ভোগের কারণে যদি বিপুল পরিমাণ সাধারণ জনতা রাস্তায় নেমে আসে তাহলে তা হবে যে কোনো শাসকের জন্য সব থেকে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। বর্তমান শাসকদের নিজের পক্ষে বলার প্রধান বিষয় হচ্ছে দেশে শান্তি-স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের রেকর্ড। কিন্তু দেশে যদি এখন অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় তাহলে তা শুধুমাত্র দরিদ্রদেরই প্রভাবিত করবে না, সামরিক কর্মীদের পরিবার, ব্যবসায়িক শ্রেণি ও মধ্যবিত্তরাও এতে প্রভাবিত হবে। এতে করে শাসকগোষ্ঠীর এই দাবি বাতিল হয়ে যাবে। বিশ্বে এমন উদাহরণ রয়েছে যেখানে বহুদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা সরকারও মধ্যবিত্ত বিক্ষোভকারীদের কাছে হঠাৎ করে হেরে গেছে। এই দৃশ্যকল্পটি সম্পূর্ণরূপে অসম্ভাব্য নয় তবে অনেকগুলো বাহ্যিক কারণের উপর নির্ভরশীল। তবে ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এই সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
দৃশ্যকল্প তিন: আবারো আপস
১৯৯৬ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি জোর করে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিল কিন্তু ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে তাদের পদত্যাগ করতে হয়। সে সময়ই নিয়মিত নির্বাচন চক্রের অংশ হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রবর্তন করা হয়। সে সময় দেশের বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক শক্তিগুলো নিজেদের মধ্যে আপস করেছিল। এখনও সেই সময়ের মতো সকল পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য নতুন কোনো ফর্মুলা বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
ক্ষমতা হারালে জীবন ও সম্পত্তির কী হবে তা নিয়ে আশঙ্কায় ভোগেন শাসক দলের সদস্যরা। তাই যে কোনো পরিবর্তনের আগে তাদের নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, ক্ষমতা হারানোর পর বর্তমান শাসকদের জীবন ও সম্পত্তিকে টার্গেট করা হবে না এবং তাদের অপরাধের তদন্ত ও বিচার হবে না। তবে বিএনপি নেতা-কর্মীদের জন্য এটা মেনে নেয়া বেশ কঠিন হবে। কারণ তারা বহু বছর ধরে তাদের পরিবার থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হয়েছে। ব্যবসা ফেলে তাদের পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের ক্ষমা ছাড়া শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা পরিবর্তন অসম্ভব। দলীয় নেতাকর্মী, বিচারক এবং পুলিশ কর্মকর্তাদের জন্যেও এটি প্রযোজ্য।
মানুষের প্রতিক্রিয়া কী হবে?
আবারও যদি বিতর্কিত কোনো নির্বাচন হয় তাহলে ভোটারদের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? নির্বাচনে হয়তো বিএনপি প্রার্থীদের তুচ্ছ কারণে বাধা দেয়া হবে, ভোটার উপস্থিতি কম থাকবে, ব্যালট বাক্স আগেই ভর্তি করা হবে, আওয়ামী লীগের গুণ্ডারা নির্বাচনী কর্মকর্তাদের হয়রানি করছে এমন ভিডিও পাওয়া যাবে। ভোটাররা খুব সম্ভবত আগে যেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, এবারও তাই দেখাবেন। বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তাতে নির্বাচনী প্রচারণায় ভোটারদের মন জয় করার থেকে বুদ্ধির খেলার ওপরে বেশি জোর দেয়া হয়। এসব জনসমাগম, রাজপথে বিক্ষোভ, ওবায়দুল কাদের ও ফখরুল ইসলামের বক্তব্য, তারেক রহমানের ভিডিও, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচন, বামপন্থি ও ইসলামপন্থিরা, নির্বাচনী আইনের পরিবর্তন, বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং খাবারের দাম বৃদ্ধি- সবই প্রকৃত প্রচারণার অংশ।
এই প্রচারণা, বুদ্ধি এবং সামর্থ্যরে প্রতিযোগিতা বহুদিন ধরেই চলছে। এখানে ক্ষমতার লড়াই নির্বাচনের মাধ্যমে মীমাংসা হয় না। ভোটাররা যদিও নির্বাচনকেই বেশি পছন্দ করেন। কিন্তু যখন পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হয়ে যায় তখন তারাও জয়ী দলের কর্তৃত্ব মেনে নেন। জয়ী দল অধিক শক্তিশালী, বুদ্ধিমান এবং সক্ষম বলেই জিতেছে এমন বাস্তবতা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়। গণতান্ত্রিক সংজ্ঞা অনুযায়ী, কারও ক্ষমতা বৈধতা পেতে হলে আগে তাকে ব্যালটে জয়ী হতে হয়। কিন্তু এই মনোভাব বাংলাদেশে এতটা শক্তিশালী নয় যে, তা বড় ধরনের প্রতিবাদ গড়ে তুলতে সক্ষম। মানবজমিন থেকে নেয়া।