নেপথ্যে চীন ও আসিয়ানের চাপ, পশ্চিমারা সতর্ক পর্যবেক্ষণে

বুধবার এবং বৃহস্পতিবার দু’দিন ধরে রাখাইনে বিভিন্ন এলাকায় নেয়া হয় ১১ জ্যেষ্ঠ কূটনীতিককে। 

নেপথ্যে চীন ও আসিয়ানের চাপ, পশ্চিমারা সতর্ক পর্যবেক্ষণে
নেপথ্যে চীন ও আসিয়ানের চাপ, পশ্চিমারা সতর্ক পর্যবেক্ষণে

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক : আচমকা প্রত্যাবাসন প্রস্তুতি শুরু করেছে মিয়ানমার। বার্মার সামরিক সরকারের এমন উদ্যোগের নেপথ্যে কী? তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ  চলছে কূটনৈতিক অঙ্গনে। ঢাকার তরফে দায়িত্বশীলদের কেউ অবশ্য এ নিয়ে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে মুখ খুলেননি। তবে অনানুষ্ঠানিক সূত্রগুলো বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে চীন এবং আসিয়ান জোটের বাড়তি চাপে বর্ষার আগেই প্রত্যাবাসন শুরু করতে সম্মত হয়েছে মিয়ানমার। একটি পাইলট প্রজেক্টের আওতায় প্রাথমিকভাবে হাজারের বেশি মিয়ানমার নাগরিককে রাখাইনে ফেরানো হবে জানিয়ে সূত্র  বলেছে, প্রত্যাবাসন শুরু করাটাই চ্যালেঞ্জের বিষয়। এটি শুরু করতে পারলে সংখ্যা ধাপে ধাপে উন্নীত হবে, ২০২৩ সালে ৫০ হাজার বাস্তুচ্যুত রেহিঙ্গাকে তাদের স্বভূমে ফেরানোর টার্গেট রয়েছে। প্রত্যাবাসন প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বাংলাদেশ, ভারত, চীনসহ আসিয়ান জোটের আটজন দূতকে মংডু এবং সিটুওয়েতে সংস্কার কর্ম করে পুরোপুরি প্রস্তুত করা ট্রানজিট ক্যাম্পগুলো সরজমিন দেখানো হয়েছে। বুধবার এবং বৃহস্পতিবার দু’দিন ধরে রাখাইনে বিভিন্ন এলাকায় নেয়া হয় ১১ জ্যেষ্ঠ কূটনীতিককে। 

ঢাকা ও নেপিডো’র দায়িত্বশীল কূটনৈতিক সূত্র জানায়, প্রত্যাবাসনের উদ্যোগকে যেকোনো সময় স্বাগত জানাতে প্রস্তুত বাংলাদেশ। তবে অবশ্য রোহিঙ্গাদের ফেরাটা মর্যাদাপূর্ণ এবং টেকসই হতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে কোনো অবস্থাতেই যেন ফিরে যেতে সম্মত পরিবারগুলোকে ভেঙে টুকরো টুকরো করা না হয়। অর্থাৎ ৬ বা ৮ সদস্যের পরিবার হলে যেন পুরো পরিবারকেই গ্রহণ করে মিয়ানমার, একটি পরিবারের কেউ যেন বাদ না পড়ে। উল্লেখ্য, এক হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে পাইলট প্রজেক্টের আওতায় ফেরাতে রাজি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাদের পরিবারভিত্তিক তালিকা দিয়েছে বাংলাদেশ। ক্যাম্পে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভালোমন্দ দেখভাল করা ইউএনএইচসিআর এবং অন্য আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর সঙ্গে মিলে ওই তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। তাতে কোনো পরিবার ভাঙা হয়নি। কিন্তু মিয়ানমার ওই তালিকার সবাইকে গ্রহণে এখনো রাজি নয়।

কিছু সদস্যকে গ্রহণে তাদের রিজারভেশন রয়েছে। পরিবারভিত্তিক প্রত্যাবাসনে তাগিদ দেয়া ছাড়াও ট্রানজিট সেন্টার বা ক্যাম্পে না রেখে পুনর্গঠিত গ্রামগুলোতে বাস্তুচ্যুতদের স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনে জোর দিচ্ছে ঢাকা। সূত্র মতে, চীন ও আসিয়ানের উদ্যোগে চটজলদি প্রত্যাবাসন শুরুর ব্যাপারে এখনো পশ্চিমাদের প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট নয়। তারা বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রেখেছে বলে মনে করছে সেগুনবাগিচা। স্মরণ করা যায়, প্রত্যাবাসন প্রলম্বিত হওয়ায় বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের একটি অংশকে ভাসানচরে স্থানান্তর নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল অনেক বছর। এ নিয়ে পশ্চিমাদের অবজারভেশন ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের রাজি করেই ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ সরকার। 

রাখাইনে যা দেখলেন ১১ কূটনীতিক: মিয়ানমারের সামরিক সরকার এই প্রথম রাষ্ট্রীয় আয়োজনে দলবদ্ধভাবে বাংলাদেশ, ভারত, চীনসহ আসিয়ানের দূতদের রাখাইন পরিদর্শনে নিয়ে যায়। সূত্রমতে, সফরের প্রথমদিনে দূতদের টেকনাফ সীমান্তের ঠিক উল্টো দিক নাফ নদের তীরে নকুইয়া গ্রামে পাঁচ বছর আগে স্থাপিত অন্তর্বর্তীকালীন শিবিরের সংস্কারকাজ দেখানো হয়। জানানো হয়, জলপথে যাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেয়া হবে, তাদের প্রথম কিছুদিন ওই শিবিরে রাখা হবে। পরে তাদের মংডুর লাপুখা শিবিরে নেয়া হবে। সেখানে মাসখানেক রেখে তাদের মংডু এবং সিটুওয়ের কাছে নির্মাণাধীন শিবিরগুলোতে স্থায়ীভাবে স্থানান্তর করা হবে। সূত্রমতে, চীনের বিনিয়োগ তৈরি হতে যাওয়া তেল কোম্পানি এবং গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য বিখ্যাত চাকফু এলাকায় ২০১২ সাল থেকে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুতদের যে শিবির ছিল, তা-ও কূটনীতিকদের দেখানো হয়। সেই সঙ্গে বলা হয়, ওই শিবিরগুলো বন্ধ করে পাশের গ্রামে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে  স্থানান্তরের পরিকল্পনা রয়েছে। ওই এলাকায় একটি মসজিদের অস্তিত্ব এখনো বিদ্যমান রয়েছে বলে দূতদের দেখানো হয়। 

পরিদর্শন টিমে থাকা এক কূটনীতিক মানবজমিনকে গতকাল বলেন, প্রত্যাবাসনের কোনো দিনক্ষণ এখনো ঠিক হয়নি। তবে পাইলট প্রজেক্টের আওতায় তারা যে হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে গ্রহণের মধ্যদিয়ে প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায় সেটি স্পষ্ট করেছে। যদিও রাখাইনে বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের দূতদের সফরের খবর প্রচারের পর থেকে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকে এ উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও পূর্ণ অধিকারের নিশ্চয়তা ছাড়া প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা চলছে। 

টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য রোহিঙ্গাদের আরও অপেক্ষার পরামর্শ রয়েছে জাতিসংঘের: এদিকে রোহিঙ্গাদের মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য সোচ্চার কণ্ঠ জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের তরফে টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য রোহিঙ্গাদের অপেক্ষার পরামর্শ রয়েছে। গত বছর ঢাকা সফর করে যাওয়া বিদায়ী হাইকশিনার এবং নতুন হাইকমিশনারের তরফে প্রায় অভিন্ন ওই পরামর্শ দেয়া হয়েছে। জানানো হয়েছে, নিজেদের অধিকার নিশ্চিত করে রাখাইনে ফিরে যেতে চায় বাস্তুচ্যুতরা। তবে রাখাইনের পরিস্থিতি কতোটা প্রত্যাবাসনের অনুকূল সেটি আগে যাচাই করতে হবে। তা না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের সেখানে পাঠানো ঠিক হবে না বলে মনে করে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশন।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: