নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা বাড়ছেই

এক বছর আগে প্রতি কেজি চিনির দাম ছিল ৮৫ টাকা। গতকাল সেই চিনি বিক্রি হয়েছে ১৪০ টাকা কেজি দরে। বছরের ব্যবধানে এই পণ্যটির দাম ৬৪ শতাংশ বেড়েছে।

নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা বাড়ছেই

প্রথম নিউজ, অনলাইন: এক বছর আগে প্রতি কেজি চিনির দাম ছিল ৮৫ টাকা। গতকাল সেই চিনি বিক্রি হয়েছে ১৪০ টাকা কেজি দরে। বছরের ব্যবধানে এই পণ্যটির দাম ৬৪ শতাংশ বেড়েছে। একইভাবে বছরের ব্যবধানে রসুনের দাম কেজিতে বেড়েছে ১৫০ টাকা। গত বছরে ৮০ টাকায় বিক্রি হওয়া রসুনের দাম এখন ২৩০ টাকা। এদিকে আবারো অস্থিরতা দেখা দিয়েছে ডিমের বাজারে। প্রতি ডজন ডিমের দাম ছুঁয়েছে ১৭০ টাকা। যা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়েছে। সবজির দামও কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। আর মাছ ও মাংসের বাজার আগের মতোই চড়া।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে এক কেজি জিরা বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ১৮০ টাকা দরে, এক বছর আগে এই পণ্যটির দাম ছিল ৪৫০ টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে প্রতি কেজি জিরার দাম বেড়েছে ৭৩০ টাকা। এক বছর আগে ১৪০ টাকায় বিক্রি হওয়া আদার কেজি এখন ৪০০ টাকা। এই পণ্যটির দাম কেজিতে ২৬০ টাকা বেড়েছে। বাজারে দেশি পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়, এক বছর আগে যার দাম ছিল সর্বোচ্চ ৫০ টাকা। ফলে বছরের ব্যবধানে দেশি পিয়াজের দাম প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমদানিকৃত পিয়াজের দামও কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ৬০ টাকা হয়েছে। অন্যদিকে আমদানিকৃত রসুনের দাম ৭৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২২৫ টাকা হয়েছে। এক বছর আগে আমদানি করা রসুনের দাম ছিল সর্বোচ্চ ১৩০ টাকা। দাম বেড়েছে শুকনা মরিচেরও। বাজারে প্রতি কেজি দেশি শুকনা মরিচের দাম ২৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৪২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে আমদানি করা শুকনা মরিচের দাম কেজিতে ৮০ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৫২০ টাকা হয়েছে। 

বাজারে প্রতি কেজি লবঙ্গ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ টাকায়। এক বছর আগে প্রতি কেজি লবঙ্গের দাম ছিল ১ হাজার ২০০ টাকা। দেশি ও আমদানিকৃত উভয় আদার দামই বৃদ্ধি পেয়েছে। এক কেজি দেশি আদার দাম নেয়া হচ্ছে ৪০০ টাকা। এক বছর আগে যার দিম ছিল ১৪০ টাকা। অন্যদিকে আমদানি করা আদা ৯১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২২০ টাকা হয়েছে। এদিকে দেশি হলুদের দাম ৮০ টাকা বেড়ে ৩৪০ টাকা এবং আমদানি করা হলুদের দাম ৩০ টাকা বেড়ে ২৫০ টাকা হয়েছে। কেজিতে দারুচিনির দাম ২০ টাকা বেড়ে হয়েছে ৫০০ টাকা। তবে এক বছরের ব্যবধানে এলাচের দাম কেজিতে প্রায় ৪০০ টাকা কমেছে। বর্তমানে ২ হাজার ৬০০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া এলাচের দাম এক বছর আগে ৩ হাজার টাকা কেজি ছিল। বছরের ব্যবধানে চাল ও আটার দামও বেড়েছে। গত বছরের এই সময়ে ৭০ টাকায় বিক্রি হওয়া চাল এখন বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকা দরে। অন্যদিকে গত বছরে ৫০ টাকায় বিক্রি হওয়া এক কেজি আটা এখন বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকা দরে। 

আগারগাঁও তালতলা ও বিএনপি বাজারের মুদি দোকানিরা জানান, আমরা যখন কিনতে যাই তখন আমাদের বলা হয় ডলার সংকট, এলসি (আমদানি ঋণপত্র) দিতে চায় না, এ কারণে দাম বেশি। এখন আমরা বেশি দামে জিনিস কিনে তো আর কম দামে বিক্রি করতে পারবো না। সকল পণ্যই বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। রাজধানীর আগারগাঁও বাজারের মুদি দোকানি নাসির হোসেন বলেন, ঈদের পর থেকেই সকল মসলা জাতীয় পণ্যের দাম বেড়েছে।

এদিকে সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় ডিমের দাম নিয়ে রীতিমতো তেলেসমাতি চলছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে গরিবের আমিষ খ্যাত ডিমের দাম। এক ডজন ডিমের দাম ছাড়িয়েছে ১৬৫ টাকা, কোথাও বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকা দামে। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে, তাই দাম বাড়তি। পোল্ট্রি শিল্প এসোসিয়েশন বলছে, করপোরেট ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে ডিম ও মুরগির দাম বাড়াচ্ছে। তেজগাঁও বাজারের ডিমের পাইকারি বিক্রেতা সাদেকুল ইসলাম বলেন, ডিমের সরবরাহ অনেক কমেছে। আমাদের চাহিদা অনুযায়ী ডিম দেয়া হচ্ছে না। এজন্য ডিমের দাম বেড়েছে।

ডিমের দাম বৃদ্ধির জন্য করপোরেট সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছেন বাংলাদেশ পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার। তিনি বলেছেন, ফিডের দাম বাড়িয়ে তারা বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। ডিম ও মুরগি উৎপাদন করে তাদের দিতে চুক্তি করলে তারা কিছুটা কম দামে ফিড ও মুরগির বাচ্চা দেয়। অন্যথায় বেশি দামে ফিড কিনতে হয়। সময় অসময়ে ডিম ও মুরগির দাম বাড়িয়ে দিয়ে করপোরেট সিন্ডিকেট লাভবান হচ্ছে। মাঝে ভোক্তাদের পকেট ফাঁকা হচ্ছে।

ওদিকে বাজারে সবজির দামও বেড়েছে। সবজি ব্যবসায়ীদের দাবি, কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে কৃষকরা ক্ষেত থেকে সবজি তুলতে পারছেন না। কিছু সবজি ক্ষেতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে সরবরাহ কমে প্রভাব পড়েছে সবজির দামে। রাজধানীর তালতলায় বাজার করতে আসা মাহমুদা সুলতানা বলেন, নতুন কোনো সপ্তাহ আসলেই আমাদের মাঝে আতঙ্ক কাজ করে। কারণ, প্রতি সপ্তাহেই কোনো না কোনো জিনিসের দাম বাড়বেই। ডিমের দাম ডজনে ৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। আগে ২০ থেকে ৩০ টাকা দিয়ে কয়েক পদের মসলা কেনা গেলেও এখন ২০ টাকা দিয়ে শুধু জিরাও কেনা যায়না। তেল ও চিনি তো অনেক আগে থেকেই বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। প্রতিদিনই নতুন করে বিভিন্ন সবজির দাম বাড়ছে। এভাবে প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়তে থাকলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়। আরেক ক্রেতা মো. ইউসুফ বলেন, বাজারে নতুন করে ডিম ও সবজিসহ বেশকিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। সংসার খরচ আগের থেকে অনেক বেড়েছে। কিন্তু আয় বাড়েনি।

কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, নিত্যপণ্যের বাজার নিজেদের ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করছে দেশের ব্যবসায়ীরা। তারা অতি মুনাফাকে জায়েজ করার জন্য বন্যা, খরা, ডলার সংকট, ইউক্রেন যুদ্ধের মতো অজুহাত সামনে আনছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এসব অজুহাতের কোনো বাস্তবতা নাই। এ ছাড়া আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী মহোদয় নিজেই বলেছেন যে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে বাজারের অস্থিরতা আরও বাড়বে, এই সুযোগ নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। তিনি বলেন, আগে যারা কারসাজির সঙ্গে যুক্ত ছিল তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এজন্য দাম বাড়ানোর সংস্কৃতি সামাজিক সংক্রামকে রূপ নিয়েছে। একটির দাম বাড়লে অন্য সবকিছুর দাম বাড়ানো হয়। তিনি বলেন, আমরা ভোক্তারা অসহায় হয়ে গেছি। এখান থেকে উত্তরণের পথ আমরা জানি না।