দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছেই
আগস্টে এ হার দুই অঙ্ক ছুঁইছুঁই করে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে। কিন্তু এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়েনি মজুরি। সার্বিক মজুরি হার বাড়ছে কচ্ছপগতিতে।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। আগস্টে এ হার দুই অঙ্ক ছুঁইছুঁই করে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে। কিন্তু এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়েনি মজুরি। সার্বিক মজুরি হার বাড়ছে কচ্ছপগতিতে। একই সময়ে এ হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৫৮ শতাংশে। বিবিএস-এর হিসাবে জুলাইয়ের তুলায় আগস্টে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশীয় পয়েন্ট হারে। আর মজুরি বেড়েছে দশমিক ০৬ শতাংশীয় হারে। ফলে মূল্যস্ফীতি গিলে ফেলছে মানুষের মজুরি। এতে জীবনযাত্রায় বিরাজ করছে চরম সংকট। বাজারে উত্তাপে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে জানান, সিপিআই (কঞ্জুমার প্রাইস ইনডেক্স) তৈরি করা হয়েছে। এটি একনেক বৈঠকে উপস্থাপনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়েও নানা কারণে করা যায়নি। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন ছাড়া এটি প্রকাশ করা হবে না।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বৃহস্পতিবার বলেন, ট্রেন্ড অনুযায়ী বছরের আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে সাধারণত মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যায়। নভেম্বরে গিয়ে আবার কমতে শুরু করে। মৌসুমগত কারণে আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে এই সময়ে কিছু শাকসবজি ছাড়া তেমন ফসল উৎপাদন হয় না। সেই সঙ্গে বৃষ্টিপাত ও বন্যা থাকে। ফলে সরবরাহ চেইন ব্যাহত হয়। পণ্য সরবরাহ ঠিক না থাকলে মূল্যস্ফীতি ঘটে। তবে সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বিভিন্ন সূত্র জানায়, আগস্টে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ, যা গত বছরের আগস্টে ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। ২০২১ সালের আগস্টে ছিল ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এদিকে কয়েক মাস ধরেই দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ওঠানামার মধ্য দিয়েই যাচ্ছে। এর মধ্যে চলতি বছরের জুলাইয়ে ছিল ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ, জুনে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং মে মাসে ব্যাপক বেড়ে হয়েছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ব্যয় বাড়ছে। সেই ব্যয়বৃদ্ধি সমস্যা হতো না, যদি একই হারে আয়টা বাড়ত। বাস্তবতা হচ্ছে-মূল্যস্ফীতি যে হারে বাড়ছে, সেই হারে আয় বাড়ছে না। ১৮ মাস ধরে দেশে এ অবস্থা বিরাজ করছে। এক্ষেত্রে মানুষ টিকে থাকার জন্য সঞ্চয় ভেঙে অথবা ঋণ করে খাচ্ছে।
কিন্তু যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, তাদের তো কোনো সঞ্চয় নেই। কিংবা কেউ ধারও দেয় না। এ অবস্থায় তারা কী করছে। প্রথমত, সন্তানদের পড়ালেখা বন্ধ করে দেয়। এরপরও না হলে চিকিৎসা খরচ বন্ধ করেন বা কমিয়ে দেন। তখনও যদি সংকুলান না হয়, তাহলে খাবার খরচ কমিয়ে দেন। এক্ষেত্রে পরিবারে এক বেলা ৫টি ডিম লাগলে দুটি দিয়েই ৫ জন খেয়ে নেন। তিন বেলার পরিবর্তে এক বেলা পেটপুরে খেয়ে দিন-রাত পার করেন। এসব করার কারণে একদিকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে, অন্যদিকে কম খাওয়ার কারণে অপুষ্টি বাড়ছে। ফলে সবদিক থেকেই ভবিষ্যতে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও বিবিএস সূত্র জানায়, আগস্টে মজুরি হার সামান্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৫৮ শতাংশে, যা জুলাইয়ে ছিল ৭ দশমিক ৫২, জুনে ৭ দশমিক ৩৯ এবং মে মাসে ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। বিবিএস-এর সিপিআই প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আগস্টে কৃষি খাতে মজুরি বাড়লেও কমেছে শিল্প ও সেবা খাতে। এক্ষেত্রে দেখা যায়, কৃষি খাতে আগস্টে মজুরি হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৮৯ এবং জুলাইয়ে ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। এছাড়া ২০২২ সালের আগস্টে এ হার ছিল ৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
কিন্তু শিল্প খাতে আগস্টে মজুরি হার কমে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৯০ শতাংশে, যা জুলাইয়ে ছিল ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এছাড়া ২০২২ সালের আগস্টে ছিল ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এদিকে সেবা খাতে মজুরি কমে হয়েছে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ, যা জুলাইয়ে ছিল ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। এছাড়া ২০২২ সালের আগস্টে এ হার ছিল ৭ শতাংশ।
রিকশাচালক সুজন মিয়া জানান, আগে সারা দিন যা আয় হতো তাই দিয়ে ভালোই চলত। কিন্তু এখন আয় কিছুটা বেড়েছে তবে বাজারে জিনিসপত্রের যে দাম, এতে সেই টাকায় কুলাচ্ছে না। দিনমজুর মো. জুয়েল জানান, বছরখানেক আগে কামলার (দিনমজুরের) হাজিরা (মজুরি) ছিল ৩০০ টাকা। সেটি বেড়ে ৪০০-৫০০ টাকা হয়েছে।
কিন্তু এতেও সংসার চলছে না। বাজারে প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। সেই তুলনায় বাড়েনি আয়। প্রায় একই কথা বলেন দিনমজুর শাহীনও। একই এলাকার রিকশাচালক মো. আলম জানান, এখন ভাড়া বেশি নিতে হয়। এরপরও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। জানি না আগামী দিন কীভাবে চলবে। গাইবান্ধা থেকে এসে রাজধানীতে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালান মো. মহসিন। তিনি বলেন, আগে সব খরচ বাদে দিনে ৫০০ টাকা থাকলেই ভালোভাবে চলা যেত। এখন এক হাজার টাকা থাকলেও চলতে হিমশিম খাচ্ছি। সেই সঙ্গে সিএনজি জমা হিসাবে মালিককে আগে ৮০০ টাকা দিতে হতো। এখন ১০০০-১২০০ টাকা দিতে হয়। পাশাপাশি বাসা ভাড়া থেকে শুরু করে চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, মরিচ, সাবান, পেস্ট, মাছ, মাংস, শাকসবজিসহ সব পণ্যের দামই বেড়েছে। যা আয় করি, এতে আর সংসারের চাকা চলে না।
দিনাজপুর থেকে ঢাকায় এসে রিকশা চালান রেজাউল করিম। তিনি জানান, আগে রিকশার জমা হিসাবে দিনপ্রতি মালিককে দিতে হতো ১০০ টাকা করে। এখন সেটি বাড়িয়ে দিতে হয় ১৩০ টাকা। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে দাম বেড়েছে। কিন্তু আয় সেই তুলনায় বাড়েনি বললেই চলে।