ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দ্বিগুণেরও বেশি বন্দির অবস্থান
কেরানীগঞ্জের কারাগারের বন্দি ধারণক্ষমতা ৪ হাজার ৫৯০ জন। অথচ সেখানে গতকাল পর্যন্ত রাখা হয়েছে ১১ হাজার ৩১৫ জন বন্দি।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: রাজনৈতিক অস্থিরতায় কারাগারে বন্দির সংখ্যা বাড়ছে। বন্দির চাপে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে ঠাঁই নেই অবস্থা। তবুও গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে বন্দিদের। প্রায় প্রতিদিন কয়েকশ’ আসামিকে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। এতে ধারণক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বন্দি নিয়ে চলছে কেন্দ্রীয় কারাগারের কার্যক্রম। কেরানীগঞ্জের কারাগারের বন্দি ধারণক্ষমতা ৪ হাজার ৫৯০ জন। অথচ সেখানে গতকাল পর্যন্ত রাখা হয়েছে ১১ হাজার ৩১৫ জন বন্দি। এই হিসাবে গতকাল পর্যন্ত ধারণক্ষমতার চেয়ে ৬ হাজার ৭২৫ জন অতিরিক্ত বন্দি ছিল। সর্বশেষ ১০ দিনে অন্তত ২ হাজার বন্দির নতুন করে ঠাঁই হয়েছে কারাগারে। বন্দির চাপ সামলাতে যেমন হিমশিম খেতে হচ্ছে কারাগার কর্তৃপক্ষকে।
ঠিক তেমনি অতিরিক্ত বন্দির কারণে বন্দিরা নিজেরাও নানা সমস্যা পোহাচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে কারাগারে যাদেরকে পাঠানো হচ্ছে তাদের প্রায় ৯৫ শতাংশই রাজনৈতিক মামলার আসামি। নামে-বেনামে বিভিন্ন মামলায় বিএনপি নেতাকর্মীদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গ্রেপ্তার করছেন। বিএনপি দাবি করেছে গত এক সপ্তাহে সারা দেশে তাদের ৪ হাজার ২৮৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে সাড়ে ৪ হাজার বন্দির ধারণক্ষমতা হলেও গত ২৯শে অক্টোবর কারাগারটিতে বন্দি ছিল ১১ হাজার ২০৬ জন। অথচ ৩রা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্দি ছিল ৯ হাজার ৭৬৫ জন। এই হিসাবে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কেরানীগঞ্জে ধারণক্ষমতার চেয়ে ৫ হাজার ১৭৫ জন অতিরিক্ত বন্দি ছিল। এছাড়া ২৯শে অক্টোবর পর্যন্ত বন্দি অতিরিক্ত বন্দি বেড়ে হয়েছে ৬ হাজার ৬১৬ জন। আর গতকাল অতিরিক্ত বন্দির সংখ্যা ৬ হাজার ৭২৫ জন।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, গত ২৮শে অক্টোবর বিএনপি’র মহাসমাবেশের আগে-পরে ২১শে অক্টোবর থেকে ৩১শে অক্টোবর পর্যন্ত ১১ দিনে শুধু ঢাকা মহানগর পুলিশ ও ডিবি ২ হাজার ১৯ জন বিএনপি’র নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। যাদের ঠাঁই হয়েছে কেরানীগঞ্জ কারাগারে। তথ্যমতে ২১শে অক্টোবর বিএনপি’র ৩১ জন, ২২শে অক্টোবর ৪২ জন, ২৩শে অক্টোবর ৪২ জন, ২৪শে অক্টোবর ৮৫ জন, ২৫শে অক্টোবর ১১১ জন, ২৬শে অক্টোবর ২০২ জন, ২৭শে অক্টোবর ৩৪০ জন, ২৮শে অক্টোবর ৬৯৬ জন, ২৯শে অক্টোবর ২৫৬ জন, ৩০শে অক্টোবর ১৫৮ জন ও ৩১শে অক্টোবর ১৪১ জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের হাজির করে। পরে আদালত তাদেরকে কারাগারে পাঠান। রাজনৈতিক মামলার পাশাপাশি, পলাতক, ওয়ারেন্টভুক্ত, মাদক মামলা, হত্যা মামলা, প্রতারণা, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, ধর্ষণসহ বিভিন্ন মামলার আসামিদের কারাগারে পাঠানো হচ্ছে।
এদিকে শুধুমাত্র ঢাকার কারাগারগুলোতে যে বন্দির চাপ বেড়েছে তা নয়। সারা দেশের প্রতিটি কারাগারেই বন্দির চাপ রয়েছে। আর চিত্র উঠে এসেছে গত ৩রা সেপ্টেম্বর সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের এক বক্তব্যে। তিনি ওইদিন বলেছেন, দেশের কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বন্দি রয়েছে। দেশের সবগুলো কারাগারে মোট বন্দি ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার ৮৬৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৪০ হাজার ৯৩৭ এবং নারী বন্দি ১৯২৯ জন। কিন্তু দেশের ৬৮টি কারাগারে ৭৭ হাজার ২০৩ জন বন্দি রয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যশোর, সিলেট, দিনাজপুর, ফেনী, পিরোজপুর ও মাদারীপুর কারাগার ছাড়া দেশের সব কারাগারে ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত বন্দি আটক রয়েছে। এরমধ্যে ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, খুলনা, নরসিংদী এবং জামালপুর কারাগার নির্মাণ বা সমপ্রসারণের কাজ চলছে। নির্মাণাধীন কারগারগুলোর কাজ শেষ হলে ধারণক্ষমতা ৫ হাজার বৃদ্ধি পাবে বলেও জানান মন্ত্রী। ওই বক্তব্য তিনি বলেন, কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের ধারণক্ষমতা ২০০ হলেও এখন ৬৩৪ জন বন্দি রয়েছে। দেশের কারাগারে সব মিলিয়ে ২ হাজার ৯৮১ জন নারী বন্দি আটক রয়েছে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুভাষ কুমার ঘোষ মানবজমিনকে বলেন, বন্দি বেশি হলেও আমরা তাদের সর্বোচ্চ সুযোগ- সুবিধা দিচ্ছি। তাদের যাতে কোনো ধরনের সমস্যা না হয় সেজন্য আমরা বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছি। বিভিন্ন তৎপরতা চালাচ্ছি।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট শিশির মনির মানবজমিনকে বলেন, বন্দির সংখ্যা হঠাৎ বাড়বে কেন? এটা স্পষ্ট যে, গেল কয়েকদিনে যেভাবে গণগ্রেপ্তার করা হয়েছে তার ফল হলো এই বন্দি বেড়ে যাওয়া। আমি মনে করি রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে আসার কারণে কাউকে হয়রানি ও গ্রেপ্তার করা সংবিধানের লঙ্ঘন। অকারণে রাজনৈতিক কর্মীদের কারাগারে রাখা মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনের শামিল। কারাগারে বন্দির সংখ্যা এভাবে বেড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক। এটা শুধুমাত্র বাংলাদেশেই সম্ভব। এটা প্রতিহিংসা থেকেই হয়েছে।
সামপ্রতিক সময়ে রাজনৈতিক বন্দির সংখ্যা বাড়ছে কিনা জানতে চাওয়া হলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি আব্দুল্লাহ আবু বলেন, বন্দির সংখ্যা উঠানামা করে। এটা নিয়মিত ঘটনা। যখন অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়, তখন বেশি গ্রেপ্তার হয়। আর গ্রেপ্তার বেশি হলে কারাগারে বন্দির সংখ্যা বাড়বে- এটাই স্বাভাবিক। তবে রাজনৈতিক কারণে বন্দি বাড়বে বলে আমার মনে হয় না। বন্দি বাড়া-কমা একটি সাধারণ ঘটনা।