জিয়াউর রহমানের লাশ নিয়ে জাতীয় সংসদে তুমুল বিতর্ক

সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের লাশ নিয়ে তুমুল বিতর্ক হলো জাতীয় সংসদে। চন্দ্রিমা উদ্যানে তার লাশ থাকা-না থাকা নিয়ে পালটাপালটি বক্তব্য দিয়েছেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির সদস্যরা। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ‘বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভস বিল-২০২১’ বাছাই কমিটিতে পাঠানো ও সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর আলোচনাকালে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন বিএনপিদলীয় সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ।পরে এ ইস্যুতে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সদস্যরা আলোচনায় অংশ নেন। এ সময় জিয়ার লাশ থাকার বিষয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধানের প্রস্তাব দেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ।সরকারদলীয় সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম স্পিকারকে উদ্দেশ করে বলেন, ওখানে যে বাক্সটা আছে তা সরিয়ে লুই কানের নকশা বাস্তবায়ন করেন। অন্যদিকে বিএনপির সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, পরনিন্দা, বিষোদগার ভালো নয়। একই দলের সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য এই বিতর্ক করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার পর তার লাশ পরিবারের কেউ দেখেননি। খালেদা জিয়া দেখেননি। তারেক রহমান লাশ দেখার জন্য কান্নাকাটিও করেছিলেন। শাহ আজিজ একটি চালাকি করেছিলেন-‘লাশ পাওয়া যাক আর না যাক, একটি বাক্স পাঠিয়ে দাও’। সেই বাক্স পাঠানো হয়েছিল। জনমনে সন্দেহ ছিল, কিসের জানাজা পড়ছি। শুধু বাক্স, নাকি ওখানে জিয়াউর রহমান আছেন? বিষয়টি নিয়ে এর আগে জাতীয় সংসদে দেওয়া নিজের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ২০ জুন ১৯৮১ সালে আমি সংসদের নতুন সদস্য। জিয়াউর রহমান তখন মারা গেছেন। বিএনপি তখন ক্ষমতায়। সংসদে আমি সরকারের কাছে এটি জানতে চেয়েছিলাম। এটা প্রসিডিংসে আছে। আমি সেদিন বলেছিলাম, আপনারা প্রমাণ করুন ওই বাক্সে কোনো লাশ আছে কিনা। জনমনের সন্দেহের কথা সেদিন সংসদে বলেছিলাম। আমি দুই দিনের মধ্যে লাশের ছবি ছাপিয়ে জনমনের সন্দেহ দূর করতে বলেছিলাম। আর না পারলে জনমনের সন্দেহই প্রমাণিত হবে। আজ ৪০ বছরেও একখানা ছবি দেখাতে পারেননি।
প্রমাণই করতে পারেননি। একখানা বাক্স দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করেছেন। একটা বাক্স এনে বলেছেন, জিয়াউর রহমানের লাশ। এ বিভ্রান্তি দূর হয়ে গেছে। ওখানে যে বাক্সটা আছে তা সরিয়ে লুই কানের নকশা বাস্তবায়ন করতে হবে। স্পিকারকে উদ্দেশ করে প্রবীণ এই সংসদ সদস্য আরও বলেন, সেখানে বাক্সটি যদি থাকে, তা সরিয়ে দিন। জিয়ার লাশ জায়েজ করার জন্য তিন বড় রাজাকারকে সংসদ ভবন এলাকায় কবর দেওয়া হয়েছে। তাদের কবরও সেখান থেকে সরিয়ে তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হবে। মানুষ এসব বিভ্রান্তি মেনে নেবে না। বিএনপির উদ্দেশে তিনি বলেন, এখানে লাশ আছে প্রমাণ করুন। এক মাস সময় দিলাম। সে সময় সেনাপ্রধান এরশাদও লাশ দেখেননি। তাহলে কী দিয়ে প্রমাণ করবেন? লাশ নিয়ে আর রাজনীতি করবেন না। ওখানে কোনো লাশ নেই, কিছুই নেই। একটি বাক্স মাটিচাপা দিয়েছে। ৪০ বছর আগে সিদ্ধান্ত হয়েছে। ক্ষমতায় থেকেও তারা প্রমাণ করতে পারেনি। একটি বাক্সের জানাজা করেছে। শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, দুই নম্বর রাজনীতি অনেক করেছেন। বাংলাদেশের মানুষ আপনাদের চিনে গেছে। আর দুই নম্বরি কইরেন না। জিয়াউর রহমান যে অপকর্ম করেছেন, তার পরিণতি দেখুন। লাশ নিয়ে যেন আর সংসদে কথা বলার সুযোগ না দেওয়া হয়। মূলত আইন প্রণয়ন কার্যাবলি সম্পাদনের সময় আলোচনার সূত্রপাত করেন বিএনপিদলীয় সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে নিয়ে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা বলছেন, তিনি মুক্তিযোদ্ধাই নন। তিনি পাকিস্তানের দোসর। বিএনপিদলীয় এই সংসদ সদস্য আরও বলেন, জিয়াউর রহমান জেড ফোর্সের কমান্ডার ছিলেন।
প্রথম, তৃতীয় ও অষ্টম ব্যাটালিয়নে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। সরাসরি মাঠে যুদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতার সময় যে সেক্টর কমান্ডাররা বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধে করেছেন, তাদের মধ্যে জেড ফোর্সের ২৮৭ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। এই সেক্টরের দুজন বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি পেয়েছেন। তার এ বক্তব্য খণ্ডন করে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ বলেন, জিয়াউর রহমান যতদিন ক্ষমতায় ছিলেন, বাংলার বাণীর কোনো কপি আর্কাইভে রাখা হয়নি। বহু তথ্য-উপাত্ত তারা সরিয়েছে। তিনি আরও বলেন, সংসদ ভবন নিয়ে লুই কানের যে নকশা, সেখানে কোথায় রয়েছে যে চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের লাশ দাফন করতে হবে? সেখানে লাশ আছে কিনা, সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, বেগম জিয়া স্বামী মনে করে কাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানান? তারই উচিত এ প্রশ্ন করা, ওনার স্বামীর লাশ সেখানে আছে কিনা? বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে নির্ণয় করা উচিত সেখানে জিয়াউর রহমানের লাশ আছে কিনা।
বিএনপির নেতাকর্মীদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আপনারা দলের নেতা ভেবে কাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন? ওখানে কি কারও মৃতদেহ আছে? নাকি অন্য কারও মৃতদেহ আছে?’ সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী বলেন, আপনারা নিরপেক্ষ একটা কমিটি করেন। সরকার সহযোগিতা করবে। সত্য উদ্ঘাটনে ভয়ের কী আছে? আপনাদের দলের নেত্রীকে বলেন, যদিও তিনি সাজাপ্রাপ্ত। প্রধানমন্ত্রীর অনুকম্পা নিয়ে, সাজা স্থগিত নিয়ে বসবাস করছেন। আইনের সুযোগ থাকলে তার নেতৃত্বে কমিটি করেন। পরে আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, পরনিন্দা, বিষোদগার ভালো নয়। সংসদের লবিতে পবিত্র কোরআনের আয়াত লেখা আছে, ‘তোমরা জানা সত্ত্বেও সত্য গোপন করিও না এবং সত্যের সঙ্গে মিথ্যা মিশ্রিত করিও না।’ তিনি আরও বলেন, ১৯৭৯ সালে সংসদ ছিল, সে সংসদে আওয়ামী লীগের ৩৯ জন ছিলেন। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে জিয়াউর রহমানের জানাজায় তারা উপস্থিত ছিলেন। সংসদে শোকপ্রস্তাব নেওয়া হয়েছিল। জিয়াউর রহমানের লাশের পোস্টমর্টেম হয়েছে, সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচারও হয়েছে। এগুলো সত্য ঘটনা। অহেতুক কথা বলে সময় নষ্ট করার দরকার নেই।
এ ইস্যুতে আলোচনায় অংশ নিয়ে একই দলের সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, আফ্রিকান একটা প্রবাদ আছে, সিংহ যদি ইতিহাস লেখতে পারত, তাহলে প্রতিটি বিজয়গাথা শিকারির হতো না। সিংহেরও বিজয়গাথা থাকত। মুশকিল হলো, সব সময় ইতিহাস লেখে জয়ীরা। তিনি আরও বলেন, এত বড় সংসদে মাত্র দু-তিনটা বিরোধী কণ্ঠ শোনা যায়। সে সময়ও সরকারি দলের সদস্যরা অসহিষ্ণু আচরণ করেন। বিএনপিদলীয় এই সদস্য বলেন, আর্কাইভ করতে হলে স্বীকার করতে হবে জিয়াউর রহমান ছিলেন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা, বীরউত্তম, সেক্টর কমান্ডার। সরকারের ব্যর্থতা, ভোট চুরি, গণতন্ত্রহীনতা, লুটপাট থেকে মানুষের দৃষ্টিকে অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য এই বিতর্ক করা হচ্ছে।
জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ইতিহাস বিকৃতি তো বিএনপিও করে। তারা বলে স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান। এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। আর জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকতে নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক বলেছেন, কখনো তা দেখিনি। তাদের প্রথমে ইতিহাস বিকৃতি বন্ধ করতে হবে। তারপর আওয়ামী লীগ যদি ইতিহাস বিকৃতি করে থাকে, তা বন্ধের আহ্বান বিএনপি জানাতে পারে।
এসব বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে পরে আবার সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ বলেন, জন্মের পর মুখে কিছু মধু দেওয়া হয়। কারও কারও মুখে মনে হয় পিতা-মাতা দিতে ভুলে গেছেন। অন্তত একজন বক্তার ব্যাপারে তিনি এটা নিশ্চিত করেই বলতে পারেন। তিনি বলেন, মৃত্যুর ৪০ বছর পর সঠিক ইতিহাস বেরিয়ে এলে সমস্যা কোথায়। জিয়াউর রহমানের লাশ আছে কী নেই, প্রমাণ করতে সমস্যা কী।